ফেসবুকে মতুয়াধর্ম এবং…….
ফেসবুকে মতুয়াধর্ম এবং…….
ইদানিং ‘ফেসবুক’ নামক ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় মতুয়াধর্ম
সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরস্পর বিরোধী বেশ তর্কবিতর্ক লক্ষ করা যাচ্ছে। একদল---
যারা প্রাচীন সনাতনধর্মের অনুসরণে নীতি-নৈতিকতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও বৈষম্যহীন
কর্মমুখী সমাজ গঠনের ধর্মকে সমর্থন করে হরিচাঁদ ঠাকুর প্রবর্তিত মতুয়ার্মকে তুলে
ধরার চেষ্টা করছেন। সেইসঙ্গে তাঁরা গৌতম বুদ্ধের নীতি-নৈতিকতা ও বৈষম্যহীন ধম্মের
সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছেন মতুয়াধর্মের। আবার ঠিক সেই একই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ডঃ
বাবাসাহেব আম্বেদকর আজীবন নীতি-নৈতিকতা বর্জিত অসাম্যের হিন্দু বর্ণধর্মের
বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, তা মিলে যাচ্ছে মতুয়াধর্মের নীতিগুলির সাথে। হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুর অবর্ণ হিন্দু তথা অস্পৃশ্য হিন্দুদের সপক্ষে যেসব কর্মকাণ্ড
করেছেন পূর্বভারতে, ডঃ আম্বেদকরও ঠিক সেইসব কর্ম করেছেন সারা
ভারতবাসীর স্বার্থে। পরবর্তী সময়ে
রাজনৈতিক দিক দিয়ে অবর্ণ ও অস্পৃশ্য হিন্দুদের বিভিন্ন অধিকার আদায়ের লড়াই করেছেন বাংলার
মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলও। সুতরাং উপরোক্ত দলে যাঁরা আছেন, তাঁরা অবর্ণ হিন্দু ও একদা অস্পৃশ্য সমাজের স্বার্থে এইসব মহামানবদের কর্মকাণ্ডের প্রচার করে থাকেন। কোনো সামাজিক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও এঁদেরকে কেন্দ্র করে তাঁরা পালন করে থাকেন। সেইসব অনুষ্ঠানে ওইসব মহামানবদের প্রতিকৃতি স্থান পাবে, তাঁদের শ্রদ্ধা জানানো হবে--- এটাই স্বাভাবিক। (এমনকি তাঁরা মহামানব হিসাবে ইংরেজি তারিখ ধরে তাঁদের জন্মদিন-মৃত্যুদিন পালন করেও তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে থাকেন।) এতে যদি কোনো ব্যক্তি বা দল গোঁড়ামি বশে তাঁদের ঠাকুরের পাশে গৌতম বুদ্ধ, ডঃ আম্বেদকর বা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের প্রতিকৃতি রেখে শ্রদ্ধা জানানোকে তাঁদের ঠাকুরের অপমান করা হয় বলে দোষারোপ করেন, সেটা তাঁদের একপেশে চিন্তাধারা এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নয়; সেটা বোকামিরই নামান্তর মাত্র।
বুদ্ধের ধম্মের নীতি-নৈতিকতা, যা ব্রাহ্মণ্য-চক্রান্তে ভারতবর্ষ থেকে প্রায় মুছেই গিয়েছিল, হরিচাঁদ
ঠাকুর সেইসব নীতি-নৈতিকতা পুনরায় ফিরিয়ে আনার কথা বলেছেন। এ কথার
সমর্থন পাওয়া যাবে “শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত” গ্রন্থে।
“বুদ্ধের কামনা তাহা পরিপূর্ণ জন্য।
যশোমন্ত গৃহে হরি হৈলা অবতীর্ণ।।”
তবে এ কথার মানে কিন্তু এই নয়
যে, বুদ্ধই হরিচাঁদ রূপে জন্ম নিয়েছেন--- বিরুদ্ধবাদীররা
প্রায়ই যে কথা বলে উপরোক্ত দলকে দোষারোপ করে থাকেন এবং সাধারণকে বিভ্রান্ত করেন। এটা
অবতারবাদে বিশ্বাসীদের কথা এবং উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা প্রচার। এখানে
এই ক’টি পংক্ততির মধ্যে এ কথা পরিষ্কার যে, বুদ্ধ
যা চেয়েছিলেন, হরিচাঁদ ঠাকুর তা পরিপূর্ণ করবেন। অবশ্য
হরিচাঁদ ঠাকুর তা পূরণ করেই যুগের প্রয়োজনে পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে তাঁর বিশ্বমানবতার
ধর্ম--- “মতুয়াধর্ম” প্রবর্তন করেন। কিন্তু
দুঃখের বিষয়, সে সময় বর্তমান কালের মতো তাঁর সমাজে শিক্ষিত
লোকের অভাব ও প্রচারযন্ত্রের অভাবের কারণেই তাঁর এই মহান ধর্ম সেভাবে প্রচার লাভ করেনি;
শুধুমাত্র আঞ্চলিক ধর্ম হিসাবেই থেকে গিয়েছে। স্বতন্ত্র
ধর্ম হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করা তো দূরস্থান, এমনকি তা বাংলার বাইরেও
ছড়িয়ে পড়তে পারেনি।
সত্যি কথা বলতে, দেশভাগের ফলেই সমগ্র ভারতবর্ষে মতুয়াধর্মাবলম্বীরা ছড়িয়ে পড়েছেন। আজ হরি-গুরুচাঁদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মতুয়াধর্মীরা শিক্ষিত হয়েছেন, কলম ধরতে শিখেছেন, মতুয়াধর্মের যুক্তি-বিজ্ঞানসম্মত সঠিক ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হচ্ছেন এবং প্রচারমুখীও হয়েছেন;
মতুয়াধর্মকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিয়ে প্রচারের আলোয়ও এনেছেন।
কিন্তু এখনও যে কাজটি বাকি তা
হল, স্বতন্ত্র ধর্ম হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়া। এখানেই
যত গণ্ডগোল! উপরোক্ত দল চাইছেন অসাম্যের ধর্ম---
বৈদিক বর্ণধর্মের কবল থেকে মতুয়াধর্মকে মুক্ত করে হরিচাঁদ ঠাকুরের সঠিক
নীতি-নির্দেশিকাকে ভিত্তি করে স্বতন্ত্র ধর্ম হিসাবে স্বীকৃতি
পেতে। আর একদল--- হরিচাঁদ ঠাকুরের বাণীর
পরিপন্থী হওয়া সত্ত্বেও আবদ্ধ থাকতে চাইছেন বৈদিক বর্ণধর্মের কুসংস্কারাচ্ছন্ন আচার-আচরণে পরিপূর্ণ অসাম্যের খোঁয়াড়ের মধ্যে; এবং দুঃখের
বিষয় হলেও, এ কথা সত্যি যে, এঁদের সংখ্যাই
দলে ভারি। তাঁরাই প্রথমোক্ত দলের বিরুদ্ধে নানা যুক্তি-বিজ্ঞান বহির্ভূত অভিযোগ খাঁড়া করে হুমকি-ধমকি দিয়ে চলেছেন।
আগেই বলা হয়েছে, বুদ্ধের কামনা পূরণ করাই ছিল হরিচাঁদ ঠাকুরের মুখ্য উদ্দেশ্য। সুতরাং
মহাজ্ঞানী বুদ্ধ সম্পর্কে যাঁরা ধারণা রাখেন তাঁরা যদি হরিচাঁদ ঠাকুরের সঙ্গে বুদ্ধের
মিল খুঁজে পান, কেউ কেউ তাঁকে নববুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করতে
চান, তাতে অবাক হবার কোনো কারণ থাকতে পারে না; বরং সেটাই সঠিক।
অন্যদিকে ডঃ বাবাসাহেব আম্বেদকরের
কর্মকাণ্ড ও তার প্রভাব ছিল সমগ্র ভারতবর্ষ তথা বিশ্বব্যাপী। তিনি
রাজনীতির আঙিনায় থেকে বৈদিক বর্ণধর্মের অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। লড়াই
করেছেন শিক্ষার অধিকার, সাম্যের অধিকারলাভের জন্য, যা পূর্বভারতে শুরু করেছিলেন হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুর। সে অর্থে
ডঃ আম্বেদকরই তাঁদের প্রকৃত উত্তরসূরি। তিনিও বুদ্ধের
সঠিক ধম্মকে উদ্ধার করে নিজে গ্রহণ করেছেন ও প্রচার করেছেন। সুতরাং
তিনি অবর্ণ হিন্দু তথা অস্পৃশ্য হিন্দুদের কাছে একজন মহামানব। তাঁকে
শ্রদ্ধা জানানো অবশ্যই কর্তব্য; এতে কারও গোসা করার কারণ থাকতে পারে
না। যাঁরা তা করেন তাঁরা তা না জেনে, না বুঝেই করেন।
কেউ কেউ ‘আম্বেদকর কেন বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছেন, মতুয়াধর্ম কেন
গ্রহণ করেননি’ বলে প্রশ্ন রেখে দোষারোপ করেন। এটা
নিতান্তই একটি শিশুসুলভ হাস্যকর প্রশ্ন। যে মতুয়াধর্ম
অদ্যাবধি বৈদিক হিন্দু বর্ণধর্মের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারেনি, আষ্টেপৃষ্ঠে সেই খাঁচার মধ্যেই আবদ্ধ, তৎকালীন সময়ে যাঁরা
স্বতন্ত্র ধর্ম হিসাবে তাকে ভাবতেও পারেননি, যার নামগন্ধও মতুয়ারা
বাংলার বাইরে প্রচার করতে পারননি, সেই ধর্ম(?) বহির্বঙ্গের কারও গ্রহণ করা বা না করার প্রশ্ন আসে কী করে? কাজেই এ প্রশ্ন যাঁরা করেন তাঁরা কিছু ভাবনাচিন্তা না করেই তা করেন;
কিংবা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যই করেন।
এই প্রসঙ্গে আরও একটি কথা প্রয়োজনীয়
মনে করি--- মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল সম্পর্কে কিছু ব্যক্তি তাঁর বিরুদ্ধবাদী
ব্রাহ্মণ্যবাদী লেখকদের রচনা ও রাজনীতিকদের প্রচার (দলিত শ্রেণির
অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করা প্রকৃত দলিত নেতাদের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ্যবাদী লেখক ও রাজনীতিকরা
যা সব সময়ই করে থাকেন) এবং কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির প্ররোচনায়
প্রভাবিত হয়ে তাঁর সম্পর্কে সঠিক তথ্য না জেনে মহাপ্রাণের সমালোচনায় নানা কটূক্তিসহ
ফেসবুকের পাতা ভরিয়ে দিচ্ছেন; সেইসব বন্ধুদের কাছে অনুরোধ,
তাঁরা যেন মহাপ্রাণ মণ্ডল সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানার চেষ্টা করেন। সঠিক
তথ্য জানার এখন আর সূত্রের কোনো অভাব নেই। একটু অনুসন্ধান
করলেই তাঁরা তা পেয়ে যাবেন।
Comments
Post a Comment