হরিচাঁদ ঠাকুর ও মতুয়াধর্ম Harichand Thakur O Matuya Dharma(Bengali)
হরিচাঁদ ঠাকুর
ও
মতুয়াধর্ম
সুধীর রঞ্জন হালদার
প্রাক্ কথন
প্রায় সর্বত্রই লক্ষ করেছি
অধিকাংশ মতুয়া ভাইয়েরা হরিচাঁদ ঠাকুর প্রবর্তিত মতুয়াধর্ম যে সম্পূর্ণ অবৈদিক এ
কথাটাই মনে রাখেন না। তাঁরা মতুয়াধর্মকে বৈদিক হিন্দুধর্মের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। হরিচাঁদ ঠাকুরকে তাঁরা অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন বৈদিকধর্মের তথাকথিত বিষ্ণুর অবতার রাম, কৃষ্ণ, গৌরাঙ্গ প্রমুখের উত্তরসূরি ভাবেন। হরিচাঁদ
ঠাকুরের জীবনীকার কবি তারকচন্দ্র সরকারও সেভাবই তাঁকে দেখিয়েছেন। যাঁরা মতুয়া নন, অথচ হরিচাঁদ ঠাকুরের কথা জানেন, তাঁরাও মনে করেন মতুয়ারা
হিন্দুধর্মের অঙ্গীভূত একটি সম্প্রদায় মাত্র। কিন্তু “শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’’
গ্রন্থ পাঠ করার পর, মতুয়াধর্ম যে সম্পূর্ণ আলাদা একটি অবৈদিক
ধর্ম এতে আমার মনে আর কোনো সন্দেহ নেই এবং সে কথা জানানোর জন্যই আমার “হরিচাঁদ
ঠাকুর ও মতুয়াধর্ম’’ পুস্তিকা লেখার প্রয়াস।
দেশভাগের কারণে পূর্ব ও পশ্চিমবাংলার বাইরে ভারতের অন্যান্য
প্রদেশেও প্রচুর সংখ্যক মতুয়া পরিবার বসবাস করেন।
তাঁদের বর্তমান প্রজন্ম বাংলাভাষা জানেন না। এ জন্য
মতুয়াধর্ম সম্বন্ধে তাঁদের ধারণা আরও করুণ। কারণ তাঁরা
মতুয়াধর্ম সম্পর্কিত বাংলায় লেখা কোনো পুস্তক পড়তেই পারেন না। মা-বাবা কিংবা ঠাকুরদা-ঠাকুরমার মুখে শুনে শুনে তাঁরা মতুয়াধর্মকে
পুরোপুরি হিন্দুধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে মেনে নিয়েছেন।
ছত্তিশগঢ় ও ওড়িশার কিছু অঞ্চলে গিয়ে আমার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে।
এ ছাড়া অন্যান্য প্রদেশের মতুয়া ধর্মাবলম্বী বর্তমান প্রজন্মের একাধিক লোকের সঙ্গে
আলাপচারিতায়ও ঠিক একই অভিজ্ঞতা জন্মেছে। সুতরাং এইসব
অভিজ্ঞতার কারণেই এই ছোট্ট পুস্তিকাখানি একাধিক ভাষায় লেখার পরিকল্পনা নিয়েছি। কিন্তু ভারতের সমস্ত আঞ্চলিক ভাষায় লেখা আমার অসাধ্য। আমার সাধ্যমতো জানা ইংরেজিসহ হিন্দি ও ওড়িআ ভাষায়ও পুস্তিকাখানি লেখার প্রয়াস
নিয়েছি। এ জন্য ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় দখল থাকা অভিজ্ঞ
ব্যক্তিবর্গ আমাকে সাহায্য করেছেন। তাঁদের প্রত্যেকের প্রতি
আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা রইল।
এ পুস্তিকায় মোটা অক্ষরের উদ্ধৃতি “শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
সুধীর রঞ্জন হালদার
মোবাঃ 9433814298 /
7407103432
॥ প্রথম পরিচ্ছেদ ॥
মহাবীর, গৌতম বুদ্ধ, গুরু নানক কর্তৃক ভারতবর্ষে যেমন বৈদিক তথা হিন্দুধর্মের
প্রতিবাদী ধর্ম হিসাবে জৈন, বৌদ্ধ, শিখ
ইত্যাদি এক একটি পৃথক ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে ঠিক তেমনই হরিচাঁদ ঠাকুর কর্তৃক
বৈদিকধর্মের প্রতিবাদী হিসাবে অবৈদিক মতুয়াধর্মেরও সৃষ্টি হয়েছে। হরিচাঁদ ঠাকুর ও
তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর আমরণ মতুয়াধর্মের প্রচার ও প্রসারকার্যে আত্মনিয়োগ
করেছিলেন। কিন্তু দুখের বিষয়, জৈন, বৌদ্ধ, এবং শিখধর্মের লোকেরা যেভাবে
ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে নিজস্ব ধর্মীয় আচার-আচরণ পালন
করে থাকেন, মতুয়াধর্মের লোকেরা তেমন করেন না। তাঁরা অধিকাংশই বৈদিকধর্মের
আচার-আচরণ পালন করে চলেছেন। হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুর বেদ, ব্রাহ্মণ্যধর্ম জাতপাত, স্বর্গযাত্রা, আত্মার শান্তি ইত্যাদি বিষয়গুলির
বিরোধিতা করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এই বিষয়গুলির বিরোধিতাকে ভিত্তি করেই সৃষ্টি
হয়েছিল মতুয়াধর্মের। এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর কর্মজীবনে যেভাবে
দেখিয়ে গিয়েছেন, সেভাবেই তাঁর লীলাগ্রন্থে কবি তারকচন্দ্র সরকার লিখিত আকারে রূপ
দিয়েছেন। অবশ্য সেই গ্রন্থে তারকচন্দ্র স্ববিরোধী উক্তি দ্বারা বৈদিক
চিন্তাধারাকেও সমানভাবে অর্ন্তভুক্ত করে একটি বিচিত্র অবস্থার সৃষ্টি করেছেন।
হরিচাঁদ ঠাকুর ও তাঁর প্রবর্তিত মতুয়াধর্মের কথা বলার
পূর্বে বঙ্গদেশ অর্থাৎ বর্তমান দুই বাংলার সেই সময়কার সামাজিক তথা অর্থনৈতিক
অবস্থা সম্পর্কে যেমন কিছু বলা প্রয়োজন, তেমনি প্রাচীন কালের ভারতীয় ধর্ম
সম্পর্কেও দু-চার কথা বলা প্রয়োজন। ইতিহাস থেকে আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি তা থেকেই
অতি সংক্ষেপে কিছু বলার চেষ্টা করছি।
আর্য-পূর্ব ভারতে প্রাচীন কাল থেকেই এক উন্নত সভ্যতা গড়ে
উঠেছিল। সেই সভ্যতা সিন্ধুসভ্যতা বা মহেঞ্জোদড়ো-হরপ্পা সভ্যতা নামে পরিচিত। তখনকার
লোকেরা প্রকৃতি-পূজারী ছিলেন। তখন স্বাভাবিক নিয়মে ন্যায়-নৈতিকতা ও সাম্যের
ভিত্তিতে যে ধর্ম গড়ে ওঠে, সেই ধর্মই ছিল আদি “সনাতনধর্ম”। সেই ধর্মে কোনো
বর্ণভেদ ছিল না, জন্মগত কারণে কেউ উঁচু, কেউ নীচু ছিলেন না। সেই যুগে অনেক
জ্ঞানীগুণী লোকের জন্ম হয়েছিল। তাঁরাই সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও মানবিক
উন্নতিকল্পে ধর্মীয় নিয়মকানুন নির্দিষ্ট করতেন। তাঁদের ‘বুদ্ধ’ বলা হত।
আর্য-পূর্ব ভারতে এরকম সাতাশজন বুদ্ধের কথা জানা যায়।
আর্যরা ভারতে এসে মূলনিবাসী ভারতীয়দের সভ্যতাকে ধ্বংস করে
দেয়। তাঁদের সম্পত্তি দখল করে নেয়। ন্যায়-নৈতিকতা ও সাম্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা
সনাতনধর্মকে তছনছ করে ব্রাহ্মণ্যধর্মের সূত্রপাত করে। ওই সময় ব্রাহ্মণ্যধর্মের
ধর্মগ্রন্থ বেদ রচনা করা হয়। এই জন্য ওই ধর্মকে বৈদিকধর্মও বলা হয়। সেই ধর্মে
উচ্চ-নীচ ক্রমানুসারে বর্ণবিভাগ করে সমাজে চতুর্বর্ণের সৃষ্টি করা হয়। বর্ণগুলি হল
যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। শূদ্রদের মধ্যে আবার বহু জাতপাতের
সৃষ্টি করা হয়। অনেককে অস্পৃশ্যও করা হয়। সকল বর্ণ ও জাতের মধ্যে কর্মবিভাগ করে
বিভিন্ন অধিকার নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। শূদ্র ও অস্পৃশ্যদের সম্পত্তি, শিক্ষা ও
অন্যান্য সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ফলে তাঁরা অমানবিকতার শিকার হয়ে
মনুষ্যেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হয় হন।
গৌতমবুদ্ধের ধর্মমত “বৌদ্ধধম্ম” প্রচারিত হলে ওই
ধর্মের ন্যায়-নৈতিকতা, সাম্য-মৈত্রী স্বাধীনতার উদারতা দেখে অধিকাংশ ভারতবাসী
মুগ্ধ হন। ভারতের বিভিন্ন রাজবংশ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হলে অধিকাংশ ভারতবাসী
বৌদ্ধধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করেন। সর্বশ্রেষ্ঠ ভারতসম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে
ওই ধর্ম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। ফলে ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া ক্ষমতা ও অধিকার ভোগের
সমাপ্তি ঘটে এবং দেশে আবার ন্যায়-নৈতিকতা ও সামাজিক সাম্য ফিরে আসে।
সম্রাট অশোকের শাসনকালে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা হলে
ব্রাহ্মণদের সমাজে সর্বোচ্চ আসনে থাকা ও একচেটিয়া অধিকার ভোগ করার সুবিধা না থাকায়
ব্রাহ্মণ্যধর্মও অবদমিত অবস্থায় থাকে। ফলে ব্রাহ্মণেরা রাগে ফুঁসতে থাকে। কিন্তু
রাজশক্তির ভয়ে তাদের কিছু করার ছিল না। অবশেষে সম্রাট অশোকের বংশধর বৃহদ্রথকে
হত্যা করে ব্রাহ্মণ সেনানায়ক পুষ্যমিত্র মগধের সিংহাসন দখল করলে বহুদিন মাথা নত
করে থাকা ব্রাহ্মণ্যধর্ম আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। রাজ্যলাভের পর পুষ্যমিত্র
বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড এবং উৎকট নির্যাতনের অভিযান চালায়। দেশে বৌদ্ধধর্ম
পালনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এজন্য সে সমস্ত বৌদ্ধভিক্কুদের হত্যা করার
আদেশ দেয় এবং প্রতিটি বৌদ্ধভিক্কুর মাথার বিনিময়ে একশো স্বর্ণমূদ্রা ঘোষণা করে।
ফলে বহু বৌদ্ধভিক্কু মারা পড়েন এবং বাকিরা নেপাল, ভুটান ও দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়
পালিয়ে যান। এভাবেই ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতন হয়।
পুষ্যমিত্রের রাজ্যলাভের পর ব্রাহ্মণ্যধর্ম পুনরায় আরও কঠোর
অবস্থান নিয়ে ফিরে আসে। ওই সময় পুষ্যমিত্রের আদেশে সুমতি ভার্গব নামক এক ব্রাহ্মণ
কর্তৃক নতুন করে ব্রাহ্মণ্যধর্মের সংবিধান কুখ্যাত মনুসংহিতা বা মনুস্মৃতি লেখা
হয়। চতুর্বর্ণ ও জাতপাত প্রথা আরও কঠোর অবস্থানে ফিরে আসে। পুনরায় মুষ্টিমেয়
ব্রাহ্মণেরা সবার উপরে থেকে সমস্ত অধিকার ভোগ করতে থাকে এবং সমাজের অধিকাংশ লোক
শূদ্র এবং কিয়দংশ অস্পৃশ্য হয়ে অধিকারহীন অবস্থায় দুর্বিসহ জীবনযাপন করতে থাকেন।
ভারতবর্ষের সর্বত্র বৌদ্ধধর্মের পতন ঘটলেও একমাত্র
ব্যতিক্রম ছিল বঙ্গদেশ বা বাংলা। পালরাজাদের শাসনকাল পর্যন্ত সেখানে বৌদ্ধধর্মের
প্রভাব অটুট ছিল। কেননা পালরাজারা নিজেরাই ছিলেন বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। পালরাজাদের
যুদ্ধে হারিয়ে কর্ণাটকের ব্রাহ্মণ রাজা বিজয় সেন বঙ্গদেশ দখল করলে সেখানেও
ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিস্তার শুরু হয়। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে ব্রাহ্মণ্যধর্মের
পৃষ্ঠপোষক গুপ্তবংশীয় সম্রাটদের সহায়তায় বাংলায় সর্বপ্রথম ব্রাহ্মণদের পুনর্বাসন
দেওয়া হয়। আর্যাবর্তের ব্রাহ্মণদের বঙ্গদেশে এনে ভূমি দিয়ে, বৃত্তি দিয়ে বসানো হত,
যাতে তারা আর্যবর্জিত বঙ্গদেশে বৈদিক ও পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রতিষ্ঠিত করতে
পারে। ধীরে ধীরে তাদের সে প্রচেষ্টা সফলতা লাভ করে। রাজা বিজয় সেনের আমলে সমগ্র
বঙ্গদেশে ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
ব্রাহ্মণ্যধর্ম বা বৈদিকধর্মই বর্তমানে হিন্দুধর্ম বলে
পরিচিত। বৈদিকধর্মের কোনো ধর্মগ্রন্থেই অবশ্য ‘হিন্দু’ শব্দের উল্লেখ নেই। তবু
বৈদিকধর্মের সমস্ত লোকেরা বর্তমানে নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দেয়। ‘হিন্দু’
একটি পারসিক শব্দ। এর অর্থ কালো, চাকর, দাস, দস্যু, পরাজিত ইত্যাদি। বিদেশী গ্রিক
ও মুসলমান শাসকেরাই ভারতবর্ষের লোকদের হিন্দু নামে অভিহিত করে। ভারতীয় শাসকদের
পরাজিত করে যখন এ দেশ দখল করে, তখন তারা এ দেশীয়দের কালো, পরাজিত বা চাকর অর্থে
হিন্দু নামকরণ করে। সেই অর্থে সকল ভারতীয়েরাই হিন্দু এবং ভারতবর্ষের নাম
হিন্দুস্থান হয়। বর্তমানে হিন্দু বলতে শুধুমাত্র বৈদিকধর্মের লোকদেরই বুঝায়।
বৈদিকধর্মের লোকেরা বিদেশীদের দ্বারা হিন্দু নামে অভিহিত
হলেও বিদেশাগত আর্য-ব্রাহ্মণেরা নিজেদেরকে প্রথমে হিন্দু বলতে রাজি ছিল না। এদেশীয়
বৈদিকধর্মী লোকদের হিন্দু বলে মেনে নিয়ে নিজেদেরকে তারা আর্য-ব্রাহ্মণ বলে পরিচয়
দিত। তারা নিজেরাই দাবি করত, তারও বিদেশাগত এবং ভারতীয়দের জয় করে এদেশের দখল
নিয়েছে। এমনকি সম্রাট ঔরঙ্গজেবের আমলেও তার প্রচলিত হিন্দুদের জন্য দেয় জিজিয়া করও
তারা দিত না। কিন্তু পরবর্তীকালে আর্য-ব্রাহ্মণেরা সংখ্যালঘু হয়ে যাবার ভয়ে
অন্যান্য হিন্দুদের সঙ্গে তারাও নিজেদেরকে হিন্দু বলে পরিচয় দিতে শুরু করে।
বঙ্গদেশের নমঃজাতির ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে যতদূর
জানা যায় তা হল, নমঃজাতির লোকেরা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন। তাঁরা সমস্ত কার্যে
পারদর্শী এবং শৌর্যবীর্যে অত্যন্ত উচ্চস্থানে ছিলেন। রাজকার্যে, সেনাবাহিনী ইত্যাদির
বীরত্বপূর্ণ পদে তাঁরা অধিষ্ঠিত ছিলেন। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পালরাজারও নমঃজাতির লোক
ছিলেন।
পালরাজাদের রাজ্যচ্যুত হওয়া ও কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসক
বিজয় সেনের শাসনকালেই নমঃজাতির অধঃপতন শুরু হয় এবং বল্লাল সেনের আমলে তা
চূড়ান্তপর্যায় পৌঁছায়। সেনরাজারাই রাষ্ট্রীয় শক্তির বলে যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা
বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতিকে বঙ্গদেশ থেকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে মুছে দিয়েছিল।
বল্লাল সেন ঘোষণা করেছিল বাংলার সমস্ত বৌদ্ধরা হয় ব্রাহ্মণ্যধর্ম গ্রহণ করবে, নয়তো
মৃত্যুকেই বরণ করবে। যারা বৌদ্ধধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্মণ্যধর্মের আশ্রয় নিয়েছিল,
তারা শূদ্রবর্ণে ঠাঁই পেয়েছিল। পরবর্তীকালে তারা বৃত্তি অনুযায়ী কায়স্থ, বৈদ্য,
রাজবংশী, মাহিষ্য, পৌণ্ড্র, কৈবর্ত, কপালি, তেলি, মালি, ভুঁইমালি ইত্যাদি নামে
চিহ্নিত হয়। কিন্তু নমঃজাতির লোকেরা ব্রাহ্মণ্যধর্ম অর্থাৎ বৈদিকধর্ম গ্রহণ করতে
রাজি না হয়ে রাজশক্তির ভয়ে পালিয়ে নদীনালা, খালবিল, জল-জঙ্গলপূর্ণ দুর্গম অঞ্চলে
আশ্রয় নেন। বর্তমান কালের যশোহর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ ইত্যাদি
জেলা ওই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। নতুন পুনর্বসিত ব্রাহ্মণেরা আগেই তাঁদের বৈদিকিকরণ
করতে না পেরে চণ্ডাল গালি দিয়ে অস্পৃশ্য করে রেখেছিল। রাজা বল্লাল সেন ক্রোধভরে
তাঁদের চণ্ডাল নামকরণ পাকাপাকি করে চিরস্থায়ী ভাবে অস্পৃশ্য করে রাখার বন্দোবস্ত
করে।
চণ্ডাল নামকরণের ফলে নমঃজাতির লোকেরা অন্যান্য সকল জাতির
লোকের কাছে অস্পৃশ্য ও ঘৃণিত হয়ে পড়েন। তাঁরা রাজশক্তির ভয়ে নিজেদের ধর্ম (বৌদ্ধধর্ম)
পালনেও অক্ষম ছিলেন। শিক্ষা ও ধর্মীয় অধিকারসহ সমস্ত মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত
হয়ে তাঁরা ধর্মহীন হয়ে পড়েন। এজন্য তাঁদেরকে পতিত বলা হত। বহুদিন পর্যন্ত ধর্মীয়
আচার পালন না করার ফলে তাঁরা বৌদ্ধধর্মকে ভুলে যান এবং ধীরে ধীরে নিজেদেরকে হিন্দু
ভাবতে শুরু করেন। পরবর্তীকলে ব্রাহ্মণদের প্ররোচনায় আস্তে আস্তে কয়েক পুরুষ পরে
তাঁরা হিন্দুদের অনুসরণ করে পূজাপার্বণ, শ্রাদ্ধক্রিয়া ইত্যাদি বৈদিক ক্রিয়ায় অংশ
নিতে শুরু করলেও তাঁদের নিজস্ব আচার-অনুষ্ঠানগুলি কিছু কিছু থেকেই গিয়েছিল। এইজন্য
অন্যান্য হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁদের অনেক আচার-অনুষ্ঠানে অমিল দেখা যায়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর
প্রথম দিকে বৈদিকধর্ম অনুসারী নিম্নবর্ণের এবং নমঃজাতির লোকদের অবস্থা অত্যন্ত
শোচনীয় ছিল। গোষ্ঠীগত জনসংখ্যার নিরিখে তাঁরাই সর্বাধিক সংখ্যায় ছিলেন। বৈদিকধর্মী
উচ্চবর্ণীয়দের দ্বারা বিভিন্নভাবে শোষিত হয়ে তাঁরা মানুষ হয়েও মনুষ্যেতর ভাবে
জীবনযাপন করছিলেন। শিক্ষার অধিকার না থাকায় তাঁরা অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে ছিলেন।
ব্যবসাবাণিজ্য ও ভূ-সম্পত্তির স্বল্পতার কারণে তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ
ছিল। নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন থেকে চিকিৎসার অভাবে তাঁদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে
উঠেছিল। ধর্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে তাঁরা সমাজে মর্যাদাহীন হয়ে পতিত শ্রেণি
হিসাবে বসবাস করছিলেন। এ ছাড়া নিম্নবর্ণের অন্যান্য শিক্ষাহীন পিছিয়ে পড়া
মানু্ষেরা যেমন— তেলি, মালি, কামার, কুমার, জেলে, কপালি, রাজবংশী, পৌণ্ড্র ইত্যাদি
সম্প্রদায়ের মানুষদের অর্থনৈতিক অবস্থা ও সামাজিক মর্যাদাও বিশেষ ভালো ছিল না।
তদুপরি প্রজাদের উপর উচ্চবর্ণীয় জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচার ছিল অত্যন্ত নির্মম।
॥ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ॥
পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার সফলাডাঙা
গ্রামে ১৮১২ খ্রিস্টাব্দের ১১ই মার্চ বুধবার (বাংলা ১২১৮ সালে) মহামানব হরিচাঁদ
ঠাকুর নমঃজাতির এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সেই সময় নমঃজাতির লোকদের চণ্ডাল
বলা হত। হিন্দুদের কাছে তাঁরা অস্পৃশ্য ছিলেন। চণ্ডালের অপভ্রংশে তাঁদের চাঁড়ালও
বলা হত। আগেই বলা হয়েছে যে, ব্রাহ্মণ পুরোহিত ও শাসকবর্গ উদ্দেশ্যমূলকভাবে
ষড়যন্ত্র করে এই জাতির লোকদের চণ্ডাল আখ্যা দিয়ে অস্পৃশ্য করে রাখে। বিশেষত বল্লাল
সেনের আমলেই এই নামকরণ চূড়ান্ত রূপ নেয়। প্রকৃতপক্ষে ব্রাহ্মণ্যধর্মের চণ্ডাল
জাতির সঙ্গে নমঃজাতির কোনো সম্পর্ক নেই। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা দরকার যে, নমঃজাতির
লোকেরা প্রকৃতপক্ষে কখনই শূদ্র ছিলেন না। কেননা, তাঁরা বৌদ্ধধর্ম ত্যাগ করে
বৈদিকধর্মে আশ্রয় নেননি। সুতরাং তাঁদের শূদ্র হবারও কোনো প্রশ্ন নেই।
চণ্ডাল জাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ ‘মনুসংহিতা’
ও ‘বৃহদ্ধর্ম পুরাণ’-এ বলা হয়েছে— শূদ্র পুরুষ এবং ব্রাহ্মণ স্ত্রীর অবৈধ
যৌনমিলনের ফলে যে সমস্ত সন্তানের জন্ম হয়েছে তাদের নিয়ে চণ্ডাল জাতি গঠিত হয়েছে।
নমঃজাতির চণ্ডাল নামকরণ সম্পর্কে এই তথ্য সঠিক নয়। এটা
সম্পূর্ণ অসম্ভব ব্যাপার এইজন্য যে, বৈদিকধর্মে ব্রাহ্মণদের চেয়ে তথাকথিত চণ্ডাল
বা নমঃজাতির লোকসংখ্যা অনেক গুণ বেশি। প্রত্যেক ব্রাহ্মণের স্ত্রীদের সঙ্গেও যদি
শূদ্ররা অবৈধ সম্পর্ক স্থাপনপূর্বক যৌনমিলন করে বছরের পর বছর সন্তান উৎপাদন করতে
থাকেন তাহলেও এত বহুল সংখ্যায় চণ্ডালের জন্ম দেওয়া সম্ভব নয়।
হরিচাঁদ ঠাকুরের পিতার নাম যশোমন্ত (যশোবন্ত নয়)
ঠাকুরও মাতার নাম অন্নপূর্ণা। হরিচাঁদ ঠাকুরের বাল্যকালের নাম ছিল হরিদাস।
কিন্তু হরিচাঁদ নিজে কারও দাসত্ব স্বীকার করতে রাজি ছিলেন না, তাই ‘হরিদাস’-এর
পরিবর্তে নিজেকে ‘হরিচাঁদ’ নামে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন।
হরিচাঁদ ঠাকুরের পূর্বপুরুষেরা মৈথিলি ব্রাহ্মণ ছিলেন বলে
অনেকে প্রচার করেন— এ কথার বিন্দুমাত্র সত্যতা নেই। অনেকে হরিচাঁদের পূর্বপুরুষ
রামদাসকে মৈথিলি ব্রাহ্মণ বলে উল্লেখ করেন, আবার কেউ কেউ তাঁকে ব্রহ্মচারী বলেও
লেখেন। তিনি নাকি শক্তিসাধকও ছিলেন। কিন্তু এ কথার সঠিক কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
হরিচাঁদ ঠাকুরের পূর্বপুরুষ রামদাস মৈথিলি ব্রাহ্মণ থেকে কী
করে নমঃজাতির লোক হলেন, সে প্রসঙ্গে প্রচলিত একটি গল্প আছে। গল্পটি এইরূপ— রামদাস
নমঃজাতির লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন বলে ব্রাহ্মণেরা নাকি তাঁকে জাতিচ্যুত এবং
সমাজচ্যুত করে। ফলে তাঁর পুত্র চন্দ্রমোহনের জন্য কোনো ব্রাহ্মণ পাত্রী না পেয়ে
তাকে নমঃজাতির মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেন। এর ফলেই নাকি তাঁরা নমঃজাতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে
যান। এটি একটি হাস্যকর গল্প ছাড়া কিছুই নয়। কেননা, হিন্দুধর্ম অনুসারে কোনো
ব্রাহ্মণ পাত্র অন্য কোনো নিম্নবর্ণের মেয়েকে বিয়ে করলে তার জাতিচ্যুত হবার বিধান
নেই। হিন্দু-শাস্ত্রানুসারে ব্রাহ্মণ যে কোনো বর্ণের মেয়ে বিয়ে করতে পারে, তাতে
তার কিংবা ভবিষ্যৎ বংশধরদের জাতিচ্যুত হবার কোনো সম্ভাবনা নেই।
প্রচলিত এই গল্পটি হরিচাঁদ ঠাকুরের জীবনচরিত বিষয়ক “শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত”
গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের পরবর্তী সংস্করণগুলিতে প্রথম পাওয়া যায়। রামদাস মৈথিলি
ব্রাহ্মণ ছিলেন উল্লেখ করে তাঁর ব্রাহ্মণত্ব নষ্ট হওয়া ও নমঃজাতির অন্তর্ভুক্ত
হওয়ার গল্পটি বিস্তৃতভাবে ছন্দাকারে সেখানে প্রক্ষিপ্ত করে লেখা হয়েছে।
গল্পটি যে সত্য নয় তা সহজেই বোঝা যায়। তারকচন্দ্র সরকার
রচিত ওই গ্রন্থের আদি সংস্করণে কোথাও এ কথা লেখা ছিল না যে, রামদাস মৈথিলি ব্রাহ্মণ
ছিলেন। যদি এ কথা সত্যি হত তাহলে হরিচাঁদ ঠাকুরের একান্ত সান্নিধ্যে আসা কবি
তারকচন্দ্র সরকার তা নিশ্চয়ই উল্লেখ করতেন।“শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত” গ্রন্থে
“মহাপ্রভুর পূর্বপুরুষগণের বিবরণ”-এ রামদাসকে কোথাও মিথিলার ব্রাহ্মণ কিংবা তাঁর
পুত্রের নমঃজাতির মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার ঘটনার কোনো উল্লেখই নেই। যা আছে তা হল—
“নাম ছিল রামদাস রাঢ়দেশে ছিল বাস
তীর্থযাত্রা করি বহুদিন।
স্ত্রী পুরুষ দুইজনে শেষে যান বৃন্দাবনে
কৃষ্ণপ্রেমে হয়ে উদাসীন॥”
তাঁরা বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্র ঘুরে শেষে কৃষ্ণভক্তদের সঙ্গে
লক্ষ্মীপাশা গ্রামে বসবাস করতে শুরু করেন। তাঁদের পুত্র চন্দ্রমোহন, তাঁর পুত্র
শুকদেব, তাঁর পুত্র কালিদাস ইত্যাদি— এভাবেই পরিচয় দিয়েছেন। তাঁদের ব্রাহ্মণত্ব
নিয়ে বা নমঃজাতির কোনো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হবার কথাও তারকচন্দ্র সরকার লেখেননি। এ
কথা সত্যি হলে নিশ্চয়ই তিনি তা উল্লেখ করতেন।
তাহলে এ গল্পটি পরবর্তী সংস্করণে কীভাবে ওই গ্রন্থে
অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে অনুমান করা যায় যে, কে বা কারা
হীনম্মন্যতাবোধে হরিচাঁদ ঠাকুর এবং তাঁর বংশধরদের হিন্দুধর্মের উচ্চতম বর্ণে
অর্থাৎ জাতে উঠাবার জন্য এই ষড়যন্ত্র করেছেন। শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত গ্রন্থের পরবর্তী
সংস্করণগুলিতে পূর্বপুরুষগণের বিবরণে প্রক্ষিপ্ত করে সেই গল্পটি পয়ার ছন্দে লেখাও
হয়েছে! কিন্তু মজার বিষয় ওই গল্পটি অর্থাৎ প্রক্ষিপ্ত অংশটি শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত
গ্রন্থের মধ্যে এখন আর নেই। এ ব্যাপারে বিদগ্ধ মতুয়াদের কাছ থেকে বিরূপ সমালোচনা হওয়ায়
বাংলাদেশের ওড়াকান্দি থেকে প্রকাশিত পরবর্তী সংস্করণগুলিতে অবার তা বর্জন করাও
হয়েছে। তবুও গ্রন্থের প্রারম্ভে বংশতালিকায় বন্ধনীর মধ্যে রামদাসকে মৈথিলি
ব্রাহ্মণ এবং চন্দ্রমোহনের স্ত্রীর নামের পাশে বন্ধনীর মধ্যে ‘নমঃশূদ্রের কন্যা’
বলে লেখা অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে মতুয়া ভক্তগণ ওই লেখা দেখে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। শুধু
তাই নয়, অনেক মতুয়াভক্ত লেখক এখনও রামদাসকে মৈথিলি ব্রাহ্মণ বলে তাঁদের লেখনি
চালিয়ে যাচ্ছেন! তাঁদের ধর্মগুরু একজন ব্রাহ্মণবংশোদ্ভূত ভেবে মনে মনে তাঁরা
নিশ্চয় গর্ব অনুভবও করে থাকবেন! এই অসত্য লেখা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। সামান্য
তিন-সাড়েতিনশো বছরের আগের ঘটনাকেই বিকৃত করে যদিএভাবে পরিবেশন করা হয় তাহলে অনুমান
করা যায় ব্রাহ্মণ্যবাদী লেখকেরা প্রাচীন ইতিহাসকে কতখানি বিকৃত করে রেখেছে!
প্রশ্ন হল, তাহলে আসল সত্য কী হতে পারে? এর উত্তরে বলা যায়—
আসল সত্য এটাই স্বাভাবিক যে, রামদাস রাঢ়দেশে (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের হুগলি,
বর্ধমান, বীরভূম ও হাওড়া জেলা) বাস করতেন। তিনি প্রথমে শক্তিসাধক ছিলেন বলেও
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত-এ দেখা যায় না, তাঁকে কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত বৈষ্ণব বলেই বর্ণনা
করা হয়েছে। নানা তীর্থস্থান ঘুরে অবশেষে তিনি যশোর জেলার লক্ষ্মীপাশা গ্রামে এসে
বসবাস শুর করেন।নিশ্চয়ই সেখানে তাঁর বিপুল সংখ্যায় স্বজাতীয়দের অর্থাৎ নমঃজাতির
লোকদের বাস ছিল বলেই সেখানে বসবাস করতে মনস্থির করে থাকবেন। অর্থাৎ রামদাস
প্রকৃতপক্ষেই নমঃজাতির লোক ছিলেন।
হরিচাঁদঠাকুরের পূর্বপুরুষদের পদবি ছিল বিশ্বাস। এ নিয়ে
অনেকে অনেক বিভ্রান্তিমূলক কথা বলে থাকেন। এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য মহানন্দ হালদার
রচিত “শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত” গ্রন্থে পাওয়া যায়। একটি মিথ্যা মামলায়
গুরুচাঁদ ঠাকুর অভিযুক্ত হলে তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে— “প্রধান আসামী
নাম শ্রীগুরুচরণ। বিশ্বাস উপাধিবলে ‘ঠাকুর’ এখন॥” (পৃষ্ঠা ৯৪,২য় কলাম)। পরবর্তী সময়ে যশোমন্ত ঠাকুরেরা কয়েক
পুরুষ ধরে নিত্য সাধুসেবা, ঠাকুরপূজা, বৈষ্ণবধর্মের আচার-আচরণ পালন করতেন। এই
কারণেই তাঁরা ঠাকুর উপাধি পেয়ে যান। এমনকি নিধিরামের পুত্র মুকুন্দরাম অশেষ গুণের
জন্য মোচাই ঠাকুর নামে খ্যাত হয়ে পড়েন। এরপর যশোমন্ত এবং তাঁর পুত্রদের ঠাকুর
নামেই সকলে চিনতেন। অর্থাৎ কার্যাবলি ও আচার-আচরণের জন্য ঠাকুর উপাধি লাভ ও পরে এই
উপাধিই পদবি হিসাবে গৃহীত হতে লাগল। অবশ্য অনেকে যশোমন্ত ঠাকুরকে কঠোরভাবে
বৈষ্ণবধর্মের আচার-আচরণ পালনের জন্য ‘যশোমন্ত বৈরাগী’ নামেও ডাকতেন।
প্রসঙ্গত একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন বোধ
করছি। ঠাকুরবংশজাত প্রমথরঞ্জন ঠাকুর মহাশয় (পি.আর.ঠাকুর) একটু অন্য কথা লিখেছেন।
তিনি লিখেছেন— “....বঙ্গদেশে ব্রাহ্মণকে ঠাকুর বলা হইয়া থাকে। ব্রাহ্মণ রামদাস
মিশ্রকেও তাহার অনুচর ও শিষ্যগণ ঠাকুর বলিতেন। সেই হইতে এই বংশের উপাধি “ঠাকুর”
বলিয়া প্রচলিত হইয়া আসিতেছে এবং বংশধরগণ সগৌরবে ঠাকুর আখ্যা বহন করিয়া চলিয়াছে।” (“আত্মচরিত
বা পূর্বস্মৃতি”— প্রমথরঞ্জন ঠাকুর, পৃষ্ঠা- ৩)। এ কথা সম্পূর্ণই মনগড়া। এ
সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য আগেই বলা হয়েছে।
হরিচাঁদ ঠাকুরেরা পাঁচ ভাই ছিলেন। তাঁদের নাম ছিল যথাক্রমে—
১)কৃষ্ণদাস, ২)হরিদাস, ৩)বৈষ্ণবদাস, ৪)গৌরীদাস এবং ৫)স্বরূপদাস। হরিদাসই পরে
হরিচাঁদ নামে পরিচিত হন।
হারচাঁদ ঠাকুর বাল্যকালে খুবই দুরন্ত ছিলেন। তাঁর
বাল্যসঙ্গী ছিল ব্রজ, নাটু, বিশ্বনাথ প্রমুখ। তাদের সঙ্গে তিনি রত্নডাঙার বিলে
গোরু চরাতে যেতেন। বৈষ্ণবদের তিনি সহ্য করতে পারতেন না। বাড়িতে বৈষ্ণবেরা এলে পিতা
যশোমন্ত ঠাকুর তাদের চরণামৃত পান করতে ও পদধূলি নিতে বললে তিনি তা অস্বীকার করতেন।
অনেক সময় তাঁদের বাড়িতে বৈষ্ণবেরা এলে তাদের ঝোলা পর্যন্ত লুকিয়ে জলে ফেলে দিতেন।
হরিচাঁদ ঠাকুরের স্ত্রীর নাম ছিল শান্তিবালা, যাঁকে আমরা
শান্তিমাতা বলে জানি। তাঁর পিত্রালয় ছিল ফরিদপুর জেলার (বর্তমান বাংলাদেশে)
‘জিকাবাড়ি’ গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ছিল ‘লোচন প্রামানিক’।
হরিচাঁদ ঠাকুরেরা জমিদার সূর্যমণি মজুমদারের জমিদারিতে বাস
করতেন। জমিদার সূর্যমণি মজুমদার মিথ্যা মামলায় ডিক্রি জারি করে ঠাকুরদের বাড়ি
নিজের নামে নিয়ে নিয়েছিলেন। এই ঘটনার পর ঠাকুর পরিবার সফলাডাঙার বাড়ি ত্যাগ করতে
বাধ্য হন। সফলাডাঙা ত্যাগ করে তাঁরা ফরিদপুর জেলারই রামদিয়ায় সেন বাড়িতে আশ্রয়
নিয়েছিলেন। সেখান থেকে পরে আবার পার্শ্ববর্তী গ্রাম ওড়াকান্দিতে শ্রীভজরাম চৌধুরীর
বাড়িতে আশ্রয় নেন।
হরিচাঁদ ঠাকুর প্রথাগত বিদ্যাশিক্ষার কোনো সুযোগ পাননি।
তখনকার দিনে চণ্ডাল নমঃজাতি অস্পৃশ্য বলে তাঁদের বিদ্যাশিক্ষার কোনো অধিকার ছিল
না। তাই তিনি লেখাপড়া শিখতে পারেননি। সুতরাং পুঁথিগত বিদ্যা তাঁর ছিল না। কিন্তু লেখাপড়া
না জানলেও তিনি ছিলেন প্রখর বুদ্ধিমত্তা এবং অত্যন্ত মেধাসম্পন্ন জ্ঞানীব্যক্তি।
ছেলেবেলাতেই তাঁর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় বন্ধুদের কাছে প্রকট হয়ে ওঠে। বন্ধু এবং সাথিরা সকলে তাই তাঁকে ঘিরে থাকতেন। সকলের সব প্রশ্নের মীমাংসা করে
দিতেন তিনি। প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও প্রখর বুদ্ধিমত্তার জোরে বিজ্ঞান ও
যুক্তিনির্ভর বৌদ্ধিকদর্শন উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। কর্মজীবনে তাঁর এই জ্ঞান ও
বুদ্ধিমত্তার দ্বারা শোষিত বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অর্থাৎ পতিত মানুষদের মুক্তিদূত হিসাবে
তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন।
তখনকার দিনে এখনকার মতো চিকিৎসা ব্যবস্থার বিশেষ কোনো সুযোগ
ছিল না, এত উন্নতিও ছিল না। গ্রামাঞ্চলের অবস্থা ছিল খুবই করুণ। গ্রামাঞ্চলে কোনো
ডাক্তারই ছিল না, বিশেষ করে পতিত জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে। জলবাহিত মারাত্মক
রোগসমূহের কারণে অনেক সময় গ্রামগুলিতে মহামারি লেগে যেত, বিশেষ করে কলেরা ও বসন্ত
রোগের সময়। শিকড়-বাকড়ের টোটকা চিকিৎসা, ওঝাদের ঝাড়ফুঁক, কবচ-তাবিজ ধারণ আর ঈশ্বরের
উপর নির্ভরই ছিল তাদের একমাত্র চিকিৎসা। হরিচাঁদ ঠাকুর নিজস্ব বুদ্ধিমত্তার বলে
গ্রাম্য মানুষদের প্রাকৃতিক চিকিৎসার চিকিৎসকের ভূমিকা গ্রহণ করেন। রোগমুক্তির
জন্য তিনি যে রোগের যাতে বৃদ্ধি হয় তাই খাবার পরামর্শ দিতেন। জ্বর হলে পান্তাভাতে
তেঁতুল খেতে দিতেন; বেদনা, অজীর্ণ, অম্লপিত্তে পিতলের থালায় তেঁতুলগোলা খেতে
বলতেন, গুটিকা রোগে গায়ে গোবর এবং গোমূত্র, মূত্রকৃচ্ছে অধিক জল বা ডাবের জল কিংবা
শরবত পান, আমাশয়ে পান ও তুলসী শিকড় সেবন, চর্মরোগে হলুদ-নিমপাতা বাটা, এরূপ
বিভিন্ন রোগে বিভিন্ন বনৌষধি ব্যবহারের ব্যবস্থা করতেন। সর্বোপরি মনোবল বৃদ্ধির
জন্য রোগীর বাড়িতে, রোগীকে সঙ্গে নিয়েই ‘হরিবোল’ নামের কীর্তন করতেন।
এই প্রাকৃতিক টোটকা চিকিৎসা এবং নামকীর্তনের ফলে রোগীর
মানসিক শক্তিবৃদ্ধির কারণে অধিকাংশ রোগেরই উপসম হত। এর ফলে গ্রাম্য মানুষদের কাছে
তিনি উদ্ধারকর্তার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান। তখনকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন বৈদিকধর্মে
প্রভাবান্বিত মানুষের কাছে তিনি তথাকথিত ঈশ্বরের অবতার রূপে পরিগণিত হন।
শুধু যে গ্রাম্য মানুষদের চিকিৎসাই করেছেন তাই নয়, পিছিয়ে
পড়া সমাজের মানুষের জন্য তিনি সকল রকম সামাজিক কাজেও অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন।
কৃষকদের প্রতি নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের প্রতিবাদে কৃষকদের নিয়ে তিনি গোপালগঞ্জ
মহকুমার জোনাসুর নীলকুঠি অভিযানের নেতৃত্ব দেন। সংসার প্রতিপালনের জন্য তিনি
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হন। এক সময়ে তিনি তেলের ব্যবসা করেন। বিভিন্ন
মুদিদ্রব্য নিয়ে এক সময়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করেও বেড়িয়েছেন। ব্যবসাবৃত্তির
প্রসার ও বিজ্ঞান সম্মত উন্নততর পদ্ধতিতে অনাবাদী জমি চাষ করে অতিরিক্ত ফসল ফলিয়ে
তিনি সবাইকে চমকে দেন। এই সমস্ত কাজ করে তিনি সকল পিছিয়ে পড়া মানুষদেরকে সংসার
প্রতিপালন ও উন্নততর জীবন গড়ার ক্ষেত্রে সঠিক পথের দিশা দেখিয়েছেন।
॥ তৃতীয় পরিচ্ছেদ ॥
অলীক কল্পনা, অসাম্য ও মিথ্যা ভেদভাব সৃষ্টিকারী বৈদিকধর্ম
তথা হিন্দুধর্মের অমানবিক নীতি-নিয়মের বিরুদ্ধে, যুক্তিবাদকে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে,
ধর্ম এবং অলীক কল্পনায় ভরা ধর্মগ্রন্থের বিরুদ্ধে— বেদ, পুরাণ, মনুসংহিতা প্রভৃতি
গ্রন্থগুলির স্বার্থান্বেষী বিধানের বিরুদ্ধে ছিল হরিচাঁদ ঠাকুরের আসল সংগ্রাম।
ওইসব মিথ্যা শাস্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন— “কুকুরের উচ্ছিষ্ট
প্রসাদ পেলেও খাই। বেদবিধি শৌচাচার নাহি মানি তাই॥” অবশেষে তিনি
বৈদিকধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ধর্ম হিসাবে, ধর্মহীন পতিত মানুষদের জন্য একটি
নতুন ধর্মের সূচনা করেন। সেই ধর্মই ‘মতুয়াধর্ম’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়।
হরিচাঁদ
ঠাকুর তাঁর সঙ্গীসাথিদের নিয়ে যেভাবে ‘হরিবোল’ ধ্বনিতে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করতেন,
বৈদিকতাকে সম্পূর্ণ বর্জন করে যে সমস্ত অবৈদিক আচার-অনুষ্ঠানে মত্ত হতেন, তাই দেখে
তাঁর বিরোধীরা, বিশেষ করে ব্রাহ্মণ-কায়স্থরা ব্যঙ্গ করে তাঁদের ‘মত্ত’— ‘মউত্তা’—
‘মতুয়া’ নামে অভিহিত করত। হরিচাঁদ ঠাকুরও সেই মতুয়া নামটি মেনে নিয়েছিলেন। তিনি
নিজেই বলেছেন— “ভিন্ন সম্প্রদায় মোরা মতুয়া আখ্যান।” এখন যিনি বা যাঁরা হরিচাঁদ
ঠাকুরের অবৈদিক আদর্শ পালন করে চলেন তিনি বা তাঁরাই মতুয়া।
আমাদের
মনে রাখতে হবে যে, মতুয়াধর্ম প্রতিষ্ঠার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে কুসংস্কারাচ্ছন্ন
শিক্ষাহীন ধর্মহীন পতিত নমঃজাতিসহ অন্যান্য অধঃপতিত জাতিদেরকে একটি ধর্মের বন্ধনে
আবদ্ধ করা, উন্নততর গার্হস্থ্য জীবনে পূর্ণ শান্তিলাভের উপায় নির্ধারণ করা এবং
সামাজিক অসাম্যের বিলোপ সাধন করে বিশ্ব-সৌভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা করা।
মতুয়াধর্ম
কর্ম এবং ন্যায়-নৈতিকতার ধর্ম, যে কর্ম নির্দোষ, বিজ্ঞানসম্মত এবং সাধুজন দ্বারা
প্রশংসিত। যা আসলে সত্যিকারের মানবতাবাদী ধর্ম হিসাবে পরিচিত। এই ধর্মের মূল
বৈশিষ্ট্য হলো কর্মভিত্তিক সত্য, সাম্য, প্রেম ও পবিত্রতার নিদর্শন। মতুয়াধর্মের
প্রধান নির্দেশিকাগুলি হচ্ছে— ১)সদা সত্য কথা বলা, ২)পরস্ত্রীকে মাতৃজ্ঞান করা,
৩)পিতামাতাকে ভক্তি করা, ৪)জগৎকে প্রেমদান করা অর্থাৎ সকল জীবকে ভালোবাসা,
৫)জাতিভেদ না করা, ৬)কারও ধর্মনিন্দা না করা, ৭)বাইরের সাধুসাজ ত্যাগ করা,
৮)শ্রীহরিমন্দির প্রতিষ্ঠা করা, ৯)ষড়রিপু থেকে সাবধান থাকা, ১০)হাতে কাম মুখে নাম
করা, ১১)দৈনিক প্রার্থনা করা ও ১২)ঈশ্বরে আত্মদান করা।
নির্দেশিকাগুলি
খুবই সরল, কারও বুঝতে কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়। তবে কারও ধর্মনিন্দা করা অর্থে
কোনো অন্যায়ের বা অন্ধবিশ্বাসের প্রতিবাদ করা যাবে না, তা কিন্তু নয়। আবার
মতুয়াধর্মে পিতামাতাই হলেন আসল ঈশ্বর। তাঁরাই সৃষ্টিকর্তা। তাঁরাই প্রজননের
মাধ্যমে সন্তানের জন্ম দিয়ে সৃষ্টিকে অব্যাহত রাখেন। সন্তানের মধ্যেই তাঁদের
পুনর্জন্ম ঘটে। সন্তানকে লালনপালন করে তাঁরাই মানুষ করে তোলেন। সন্তানেরও প্রথম ও
প্রধান কর্তব্য হল পিতামাতার সেবা করা, তাঁদের দুঃখকষ্ট, অভাব-অভিযোগের আশু সমাধান
করা।
“পিতামাতা বৃক্ষের গোড়া হরি বৃক্ষের ফল।”
শ্রীহরিমন্দির
প্রতিষ্ঠা করা অর্থে যুক্তি-বিজ্ঞান বহির্ভূত কোনো ভক্তিবাদের কথা নয়, এর
অন্তর্নিহিত সত্যকে উপলব্ধি করতে হবে। হরি বলতে বৈদিকধর্মের কল্পিত বৈকুন্ঠের
হরিকে নয়, মতুয়াদর্শনে হরি বলতে দেহের জড়তা ও হৃদয়ের মালিন্য অর্থাৎ হিংসা ও ঘৃণার
মানসিকতা, পরশ্রীকাতরতা, নীচতা ইত্যাদি হরণ করার ক্ষমতা আছে যার। ন্যায়-নৈতিকতা,
প্রেম, সমদৃষ্টি, জীবসেবা, সংযম ও নিষ্ঠা ইত্যাদিই চরিত্রের সমস্ত দোষ বিনষ্ট করতে
পারে। এই সকল গুণের সম্মিলিত শক্তিই হরি।(সর্বগুণসমন্বিত হরিচাঁদ ঠাকুরের আদর্শই
সেই হরি।) দৈনিক প্রার্থনা বলতেও বৈদিক হিন্দুদের মতো কল্পিত কোনো দেবদেবীর কাছে
আত্মনিবেদন, পূজা বা কোনোকিছু কামনার প্রার্থনা নয়, অত্যুন্নত জীবনচর্চায় যাতে
সর্বাঙ্গ সুন্দর মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে, তার নিরন্তর অনুশীলন করাকেই প্রার্থনা বলা
হয়েছে।
ঈশ্বরে
আত্মদান বলতেও কল্পিত কোনো সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তারূপ ঈম্বরের কাছে নিজেকে সঁপে
দেওয়া নয়। মতুয়াধর্মে ঈশ্বরের সংজ্ঞাই আলাদা। “যে যারে উদ্ধার করে সে তার
ঈশ্বর।” উদ্ধার অর্থাৎ অধঃপতিত অবস্থা থেকে উন্নততর জীবনে উত্তরণ ঘটানো। আর
সেই ঈশ্বরের আদর্শ পালন করাই তাঁর কাছে আত্মদান। এখানে হরিচাঁদ ঠাকুরই পতিত জাতির
উদ্ধারকর্তা, তাঁর আদর্শ অনুসরণ করাই তাঁকে আত্মদান। তাঁর মন্দির প্রতিষ্ঠা করে
তাঁকে স্মরণ, মনন ও আত্মদান করার কথাই এখানে বলা হয়েছে।
অনেকে
মতুয়াধর্মকে হিন্দুধর্মেরই শাখাধর্ম বলে প্রচার করেন। কিন্তু এ কথা ঠিক নয়।
মতুয়াধর্ম সম্পূর্ণ একটি আলাদা ধর্ম। এটি হিন্দুধর্মের কোনো শাখাধর্ম নয়, তার
সঙ্গে এর কোনো সম্পর্কও নেই। হিন্দুধর্ম বেদকে মান্য করে তাই বৈদিকধর্ম, কিন্তু
মতুয়াধর্ম বেদ মানে না, তাই অবৈদিক ধর্ম।মতুয়াধর্মে কাল্পনিক কোনো দেবদেবীর স্থান
নেই বা তাদের পূজারও কোনো বিধি নেই।
অনেক
মতুয়াধর্মী লোকের বাড়িতে বিভিন্ন বৈদিক দেবদেবীর পূজার প্রলন দেখা যায়। হরিচাঁদ
ঠাকুরের প্রতিকৃতির পাশে নানা বৈদিক দেবদেবীর প্রতিকৃতিরও আরাধনা করতে দেখা যায়,
এটা কোনোমতেই ঠিক নয়। দেবদেবী হল বৈদিকধর্মের কল্পনার সৃষ্টি। বাস্তবে এর কোনো
অস্তিত্ব নেই। মতুয়াধর্ম অবৈদিক ধর্ম, তাই বৈদিক দেবদেবীর পূজাও নিষিদ্ধ। কিন্তু
সাধারণ মতুয়ারা অজ্ঞতাবশত ব্রাহ্মণদের প্ররোচনায় অভ্যাসবশে এসব করে থাকেন। কিছু
কিছু মতুয়াধর্ম বিষয়ক বই-পুস্তকে বিভ্রান্তিমূলক লেখায় সাধারণ মানুষের মধ্যে বৈদিক
দেবদেবীর পূজা করার ভ্রান্ত অভ্যাস দূর হবার পরিবর্তে আরও বেশি করে প্রচলিত হবার
প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়।
হরিচাঁদ
ঠাকুরকে অধিকাংশ লোকই বৈদিকধর্মের বিষ্ণুর অবতার বলেন। এটা বলা মোটেই সমীচীন নয়।
হিন্দুধর্ম ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্মে ‘অবতার’ নেই। অবতার একটি ব্রাহ্মণ
ঋষিদের দেওয়া কাল্পনিক চাতুর্যপূর্ণ উপাধি। প্রকৃতপক্ষে মূলনিবাসী ভারতীয়দের মধ্যে
যারা আর্য-ব্রাহ্মণদের পক্ষাবলম্বন করে তাদের স্বার্থরক্ষাকল্পে মূলনিবাসীদের
নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, তাদের রক্ষণাবেক্ষণে অকাতরে অর্থব্যয় এবং সমাজে সকলের
ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করেছে, আর্য-ব্রাহ্মণেরা তাদেরকেই ‘অবতার’ উপাধি দিয়েছে। রাম,
কৃষ্ণ ইত্যাদি তারই উদাহরণ। মতুয়াধর্ম যখন হিন্দুধর্ম থেকে স্বতন্ত্র একটি ধর্ম,
তখন অবতার বলারও কোনো যুক্তি নেই। হরিচাঁদ ঠাকুর একজন রক্তমাংসে গড়া মহামানব,
বিপ্লবী সংগ্রামী, মতুয়াধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম
বুদ্ধকেও হিন্দুরা ধোঁকা দেওয়ার উদ্দেশ্যে অবতার বলে। কিন্তু তাঁর অনুগামী বৌদ্ধরা
তা বলেন না।
॥ চতুর্থ পরিচ্ছেদ ॥
মতুয়াধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হচ্ছে
সত্য-প্রেম-পবিত্রতা, সাম্য, মৈত্রী ও সততা, সকলের প্রতি ভালোবাসা, কাউকে ছোটো বা
নীচ না ভাবা, সকলের জন্য সমান স্বাধীনতা, সমান অধিকার, কাল্পনিক কোনো ঈশ্বরের
সন্ধান না করে মানুষ তথা জীবসেবার মাধ্যমেই আনন্দপ্রাপ্তি অনুভব করা ইত্যাদি।
মতুয়াধর্ম অনেকটাই ভারতের প্রাচীন সনাতনধর্ম ও বৌদ্ধধর্মকে
অনুসরণ করে। তবে তার থেকেও একে আরও সহজ-সরল, গৃহধর্মী, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানসম্মত
করা হয়েছে। মতুয়াধর্মকে ‘সূক্ষ্ম সনাতনধর্ম’ কিংবা বৌদ্ধধর্মের নব সংস্করণও
বলা যায়।
মতুয়াধর্মকে সূক্ষ্ম সনাতনধর্ম বলার কারণ হচ্ছে— প্রাচীন
সনাতনধর্মের সঙ্গে এর বহুলাংশেই মিল রয়েছে। সাম্য ও ন্যায়-নৈতিকতার ভিত্তিতে গড়ে
ওঠা আদি সনাতনধর্মে কোনো বর্ণভেদ ছিল না, জন্মগত কারণে কেউ উঁচু, কেউ নীচু ছিলেন
না। সমাজে সকল বিষয়েই সকলের ছিল সমান অধিকার। যোগ্যতা অনুযায়ী যে কেউ যে কোনো কাজে
লিপ্ত হতে পারতেন। মতুয়াধর্মও এই সকলকে ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয়েছে। এই জন্য এই
ধর্মকে ‘সূক্ষ্ম সনাতনধর্ম’ নামে অভিহিত করা হয়। এই নামটি সঠিকভাবেই মতুয়াধর্মের
সঙ্গে প্রযোজ্য।
বৈদিক বা হিন্দুধর্মকে কখনই সনাতনধর্ম বলা যায়না। হিন্দুরা
জোর করে নিজেদের ধর্মকে সনাতনধর্ম হিসাবে অভিহিত করলেও তা প্রকৃতপক্ষে সনাতনধর্ম
নয়। কেননা, সনাতনধর্মের মূলনীতি সাম্য, ন্যায়-নৈতিকতা ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শ
হিন্দুধর্ম থেকে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। হিন্দুধর্ম হল বর্ণধর্ম; অর্থাৎ মানুষে
মানুষে ভেদাভেদপূর্ণ উচ্চ-নীচ স্তরে বিন্যাস করে চতুর্বর্ণের সৃষ্টি করা হয়েছে।
শূদ্রদেরকে আবার হাজার হাজার জাতে বিভক্ত করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এটি তার
সনাতনত্ব হারিয়ে এক নতুন ধর্মে পরিণত হয়েছে। প্রাচীন প্রাকৃত সনাতনধর্মের সম্পূর্ণ
বিপরীত হচ্ছে হিন্দুধর্ম বা বৈদিকধর্ম।
মতুয়াধর্ম যে বৌদ্ধধর্মের এক নব সংস্করণ এ কথার সমর্থন আমরা
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত গ্রন্থেই পাই, যেখানে কবি তারকচন্দ্র সরকার বলেছেন—
“বুদ্ধের কামনা তাহা পরিপূর্ণ জন্য।
যশোমন্ত গৃহে হরি হৈল অবতীর্ণ॥”
এখানে বুদ্ধের বলতে গৌতম বুদ্ধকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ গৌতম
বুদ্ধের আদর্শ প্রচার করার উদ্দেশ্য নিয়েই হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর এই মহান অবৈদিক ধর্ম
প্রবর্তন করেছিলেন। ধর্ম প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে এই জাতির উন্নতিকল্পে এবং নিজেদের
প্রাচীন ঐতিহ্যকে ফিরে পাওয়ার জন্য যে সকলের শিক্ষাপ্রসারের প্রয়োজন এই উপদেশই
তিনি দিতেন। অবশ্য শিক্ষাদানের জন্য তিনি তাঁর স্বল্পকালীন জীবদ্দশায় তখনকার
পরিবেশ-পরিস্থিতির মধ্যে বিশেষ কিছু করে যেতে পারেননি। কিন্তু সকলকে যেমন উপদেশ
দিয়ে গেছেন, তেমনি তিনি তাঁর এই অপূর্ণ কাজ পূর্ণ করার জন্য পুত্র গুরুচাঁদ
ঠাকুরকে নির্দেশ দিয়ে যান।
হরিচাঁদ ঠাকুরের ধর্মান্দোলনে শুধু যে নমঃ, কপালি, মাহিষ্য,
পৌণ্ড্র, গয়লা, তেলি, মালি, মুচি, মালো ইত্যাদি অনুন্নত শ্রেণির মানুষই আকৃষ্ট হয়ে
মতুয়াধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তাই নয়, সমাজের সর্বস্তরের মানুষই আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এমকি
কায়স্থ, বৈদ্য, ব্রাহ্মণ, খ্রিস্টান, মুসলমান ইত্যাদি জাতিধর্মের লোকেরাও এই ধর্মে
যোগ দেন। তাঁর মহান আদর্শে অণুপ্রাণিত হয়ে বর্ণাভিমান দূরে ছুঁড়ে ফেলে অনেকেই তাঁর
ভক্ত হয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে অক্ষয় চক্রবর্তি, মুন্সেফ রসিক সরকার, রামভরত মিশ্র,
নবীন বসু প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
মতুয়াধর্মে কোনো গুরুগিরি বা দীক্ষা দেওয়া-নেওয়ার প্রথা
নেই। মতুয়াদের একমাত্র গুরু হরিচাঁদ ঠাকুর। মতুয়াধর্মে তীর্থভ্রমণ করতেও নিষেধ করা
হয়েছে। অযথা অর্থব্যয়ে তীর্থভ্রমণ করে কোনো লাভ হয় না। বিভিন্ন মন্দিরে অর্থব্যয়
করে মিথ্যা দেবতার পূজা দিয়েও কোনো লাভ নেই। এতে একমাত্র ভণ্ড-প্রতারক
ব্রাহ্মণ-পুরোহিতদেরই লাভ হয়। তাই সমস্ত ধর্মকর্ম অর্থাৎ সৎকাজ, সৎচিন্তা,
পরোপকার, মানুষের সেবা ইত্যাদি গৃহে বসেই করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এইজন্য
মতুয়াধর্মকে গার্হস্থ্যধর্ম বলা হয়েছে।
আজকাল দেখা যায় কিছু কিছু মতুয়া গোঁসাই ‘মহর্ষি’, ‘আনন্দ’,
‘গোস্বামী’, ‘মহারাজ’ ইত্যাদি ব্রাহ্মণ্যধর্মী উপাধিগ্রহণ করে নিজেই
গুরু সেজে দীক্ষা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। এসব মতুয়াধর্ম অনুমোদন করে না। এগুলি মতুয়াধর্মে
সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। যাঁরা এসব করে বেড়ান তাঁরা হরি-গুরুচাঁদের ধর্ম-দর্শন
অর্থাৎ মতুয়াধর্মকে না বুঝে বৈদিকধর্মের অনুসরণ করে এসব করে থাকেন। তাঁদের উচিত
মতুয়াধর্মের দর্শনকে সঠিক উপলব্ধি করে অবিলম্বে এসব পরিত্যাগ করা। অবশ্য কেউ কেউ
জেনেবুঝে চতুরালি করে অর্থ-প্রতিপত্তি ও অনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যেওএসব করে
থাকেন। খাঁটি মতুয়াদের উচিত তাঁদের এই ভণ্ডামি থেকে বিরত করা।
অনেকে আবার মতুয়ামতে ক্রিয়াকর্ম করার বইও লিখেছেন।
গুরুপূজা, অঞ্জলি, নৈবেদ্য ইত্যাদির জন্য সংস্কৃতে মন্ত্র লিখেছেন। এ সমস্ত কখনই
ঠিক নয়, এ সমস্ত সম্পূর্ণ বৈদিক ক্রিয়াকর্মেরই অনুরূপ। মতুয়াধর্মে যেমন গুরুবাদের
কোনো স্থান নেই, তেমনি সংস্কৃত মন্ত্রেরও কোনো মানে নেই।মতুয়ারা কি সংস্কৃতে কথা
বলেন, না হরিচাঁদ ঠাকুর সংস্কৃতে কথা বলতেন? এ সমস্ত কিছু লোকের বৈদিকধর্মী
মস্তিষ্কপ্রসূত ফসল, যা করে মতুয়াধর্মটিকে তাঁরা নতুন করে ব্রাহ্মণ্যধর্মী করে
তুলছেন। এর দ্বারা শুধুমাত্র পৈতাধারী ব্রাহ্মণ বর্জনই হয়েছে। বৈদিক সংস্কার—
হরিচাঁদ ঠাকুর যার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন, তা থেকে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ মতুয়াধর্মমতে
ক্রিয়া তার দ্বারা হচ্ছে না।
মতুয়াধর্ম একটি স্বতন্ত্র অবৈদিক ধর্ম। হিন্দুধর্ম তথা
বৈদিকধর্মের সঙ্গে এর আকাশ পাতাল পার্থক্য, অল্পকথায় এগুলি ব্যাখ্যা করা যায় না।
তথাপি মতুয়াধর্ম ও হিন্দুধর্মের মধ্যে প্রধান প্রধান পার্থক্যগুলি এখানে
পর্যায়ক্রমে বলা হচ্ছে—
১)মতুয়াধর্ম যে হিন্দুধর্ম থেকে আলাদা, তার প্রথম এবং
প্রধান প্রমানই হল— “বেদবিধি নাহি মানে মতুয়ারগণ।” বেদই হল হিন্দুদের আসল
ধর্মগ্রন্থ, সর্বজনমান্য। হিন্দুদের মতে বেদ অভ্রান্ত, বেদ সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন
করা চলবে না। এ জন্যই হিন্দুধর্মের আসল নাম বৈদিকধর্ম। তাহলে যাঁরা বেদকে মানেন
না, তাঁরা কী করে হিন্দু হবেন? এটা নিতান্তই অমূলক।
২)হিন্দু তথা ব্রাহ্মণ্য দর্শনে একটি মতবাদ হচ্ছে— আত্মার
মুক্তিলাভের জন্য বৈদিক যজ্ঞ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান যথাযথরূপে সম্পন্ন করা এবং
ব্রাহ্মণকে উপঢৌকন ইত্যাদি দান করা। যাগযজ্ঞ মানেই বলিদান প্রথা এবং জীবহত্যা।
জীবহত্যা করে এবং ব্রাহ্মণকে দান করলেই ধর্মলাভ তথা মুক্তিলাভ হয়— এ কথা ঠাকুর
হরিচাঁদ মানেন না।
৩)ব্রাহ্মণ্য দর্শনে আর একটি মতবাদ হচ্ছে— চতুর্বর্ণ
ব্যবস্থা। এটি হলো ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র— এই চারটি বর্ণের সমাজ
ব্যবস্থা। এই সমাজ ব্যবস্থা বেদে আছে। বেদ যেহেতু অভ্রান্ত এবং বেদের কর্তৃত্ব
যেহেতু প্রশ্নাতীত, সেই হেতু এই সমাজ ব্যবস্থাটিও অবশ্য পালনীয় এবং প্রশ্নাতীত। এই
সমাজ ব্যবস্থায় সাম্য থাকবে না। সর্বোচ্চে থাকবে ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণের নীচে
ক্ষত্রিয়, কিন্তু তারা অবশ্যই থাকবে বৈশ্যের উপরে। বৈশ্য ক্ষত্রিয়ের নীচে, কিন্তু
শূদ্রের উপরে। আর শূদ্ররা থাকবে সকলের নীচে। কিন্তু মতুয়াধর্মে বর্ণব্যবস্থার কোনো
স্থান নেই, উচ্চ-নীচ ভেদাভেদও নেই; কেউ ব্রাহ্মণও নয়, কেউ শূদ্রও নয়— সকলেই মতুয়া।
৪)হিন্দুধর্মের সমাজ ব্যবস্থায় প্রত্যেকটি বর্ণের পেশাও
নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ব্রাহ্মণের পেশা হচ্ছে শিক্ষালাভ করা ও শিক্ষাদান করা
এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদযাপন করা। ক্ষত্রিয়দের পেশা যুদ্ধ এবং রাজ্যশাসনে অংশগ্রহণ
করা, বৈশ্যের পেশা ব্যবসাবাণিজ্য ও কৃষিকার্য এবং শূদ্রের পেশা অন্য তিন বর্ণের
সেবা করা। এই পেশায় কোনো পরিবর্তন করা চলবে না। পুরুষানুক্রমে এটা চলতেই থাকবে। এ
ছাড়া শিক্ষার অধিকার থেকে সমস্ত নারীসমাজ ও শূদ্রদের বঞ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু
মতুয়াধর্মে নারী-পুরুষ সকলেরই সমান অধিকার স্বীকৃত। বর্ণব্যবস্থা নেই, যোগ্যতা
অনুসারে সব কাজ সবাই করবে। বংশগত কোনো পেশা বলে কিছু নেই।
৫)বৈদিকধর্ম যুক্তি-বিজ্ঞান বহির্ভূত অলীক কল্পনার উপর
প্রতিষ্ঠিত। বর্ণভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার এই ধর্মে সবার উপরে ব্রাহ্মণ রয়েছে বলেই
এর এক নাম ব্রাহ্মণ্যধর্ম। এই ধর্মমতে ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে
ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্য এবং পা থেকে শূদ্রের সৃষ্টি হয়েছে। বেদ, ব্রাহ্মণ,
পুরাণ, গীতা, ভাগবত, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি সকল শাস্ত্রগ্রন্থেই বর্ণবাদের কথা
আছে। মূলে চার বর্ণীয় হলেও বর্ণের মধ্যে আবার হাজার হাজার জাতিতে (ছয় হাজারের
উপরে) বিভক্ত। এক জাতির অন্য জাতির সঙ্গে বিবাহাদি বা কোনো সামাজিক ক্রিয়াকর্ম চলে
না। এক জাতি অন্য জাতির আহার গ্রহণ করে না। সবকিছুতে বিভেদ। নিম্নর্ণের হিন্দু যতই
চরিত্রবান, সদগুণসম্পন্ন হোন না কেন, তিনি কোনো ব্রাহ্মণের সমকক্ষ হতে পারেন না।
ধর্মীয় কাজের অধিকারী একমাত্র ব্রাহ্মণই। এমনকি নিম্নবর্ণের লোকদের বেদ পাঠের
অধিকার নেই। বেদ মানতে হবে অথচ পড়া যাবে না— কথাটা পরস্পর বিরোধী। ব্রাহ্মণেরা
বেদবাক্য বলে যা বলবে তাই মানতে হবে! সত্যমিথ্যা জানার অধিকার কারও নেই! আবার
এজন্য ব্যবস্থাও করেছে চমৎকার— লেখাপড়া শিখে যদি বেদ পড়ে বুজরুকি ধরে ফেলে কেউ,
তাই লেখাপড়া শেখাই মানা!
৬)বৈদিকধর্মে নারী নরকের দ্বার! ধর্মকর্মে তার কোনো স্থান
নেই। শূদ্রের মতোই নারীকেও বেদপাঠ ও শ্রবণ করার অধিকার দেওয়া হয়নি। মতুয়াধর্মে এই
অমানবিক রীতিকে স্থান দেওয়াহয়নি। হরিচাঁদ ঠাকুর বলেছেন— “ভেদাভেদ জ্ঞান নাই
নারী কি পুরুষ।” অন্যত্র বলেছেন— “করিবে গার্হস্থ্য ধর্ম লয়ে নিজ নারী।”
৭)এ ছাড়া হিন্দুধর্মে আছে অস্পৃশ্যতা।
নিম্নবর্ণের অনেক সম্প্রদায় এবং আদিবাসী শ্রেণির মানুষ উচ্চবর্ণ হিন্দুর কাছে
অস্পৃশ্য। এদের ছুঁলেও নাকি পাপ হয়, জাত যায়! আবার পশুর বিষ্ঠা খেয়ে, ব্রাহ্মণকে
দক্ষিণা দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করে তবে জাতে উঠতে হয়। হিন্দুধর্মের বিধানদাতা মনু
শূদ্র ও অস্পৃশ্যদের সম্বন্ধে বলেছেন— “বেদপাঠ শ্রবণ করলে শূদ্রের কানে গলিত
লোহা, সীসা বা লাক্ষা দিয়ে বন্ধ করবে; উচ্চারণ করলে জিভ কেটে ফেলবে; যদি মুখস্থ হয়ে
যায় তার দেহ কেটে দ্বিখণ্ডিত করবে।” পরাশর সংহিতায় বলা হয়েছে— “ব্রাহ্মণ
জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গে দেবতাদেরও পূজ্য হয়। সর্বপ্রকার পাপী হলেও ব্রাহ্মণকে কখনও
বধ করবে না।” হিন্দুশাস্ত্রের সর্বত্র ব্রাহ্মণের গুণগান। ‘নিকৃষ্ট ব্রাহ্মণ
গুণী শূদ্রের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।’ মতুয়াধর্মে জাতিভেদ নেই। মতুয়ার চোখে সবাই সমান।
জন্মের দ্বারা মানুষ ঘৃণ্য বা পূজ্য হয় না, হয় কর্মের দ্বারা। ব্রাহ্মণ বলে কোনো
বিশেষ অধিকারভুক্ত মানুষ মতুয়াধর্মে নেই। মতুয়াধর্মে পরম পুরুষার্থ প্রেম। প্রেমের
দ্বারাই সমস্ত কিছু জয় করা যায়।
৮)হিন্দুধর্মের লোক অন্য ধর্ম গ্রহণ
করতে পারে; কিন্তু অন্য ধর্মের লোক হিন্দুধর্ম গ্রহণ করতে পারে না। এটা
হিন্দুধর্মের বিধান। এই বিধান মতুয়ারা মানেন না। অন্য ধর্মের লোক মতুয়া হতে পারেন
হরিচাঁদ ঠাকুরের দ্বাদশ আজ্ঞা পালন করে, হরিবোল মন্ত্র আশ্রয় করে অর্থাৎ হরিচাঁদের
আদর্শ অনুসরণ করে।
এ ছাড়া হিন্দুধর্মের সঙ্গে আরও বহু
পার্থক্য রয়েছে যা সাধারণ মতুয়ারা মেনে চলেন না বা সঠিকভাবে জানেনও না। মতুয়াদের
বৈদিক ব্রাহ্মণ দিয়ে ধর্মকার্য নিষ্পন্ন করার কোনো প্রয়োজন নেই। হরিচাঁদপুত্র
গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেছেন, বেদবিধি, শৌচাশৌচ, তন্ত্রমন্ত্র, শুভাশুভ— এসব কিছুতেই
তাঁর বিশ্বাস নেই। তিনি মতুয়াদের এসব বর্জন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। যাগযজ্ঞ,
সন্ন্যাস বা বানপ্রস্থের কোনো প্রয়োজন নেই। ব্রাহ্মণ গুরুর কাছে দীক্ষা নেওয়া বা
তীর্থভ্রমণেরও দরকার নেই। ঘরে থেকেই নিষ্ঠার সঙ্গে গার্হস্থ্য ধর্ম পালনের নির্দেশ
দিয়েছেন তিনি।
মতুয়াধর্ম প্রবর্তন একটি ধর্মবিপ্লব।
ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতবর্ষে মতুয়াধর্ম প্রবর্তন— বেদ, ব্রাহ্মণ, যাগযজ্ঞ বিরোধী এক
ধর্মান্দোলন বা ধর্মবিপ্লব ছাড়া আর কিছুই নয়। জাতপাত, ধর্মবর্ণ, সম্প্রদায় ইত্যাদি
বিভেদপন্থীদের বিরুদ্ধে হরিচাঁদ ঠাকুর কর্তৃক এ এক যুদ্ধ ঘোষণাও বটে। মতুয়ারা
প্রত্যেকেই সেই যুদ্ধের এক-একজন সৈনিক, যে যুদ্ধে নারী ও পুরুষেরা সমান মর্যাদায়
প্রতিষ্ঠিত।
‘মতুয়াধর্ম’-এর একটি নিশান আছে। এই
নিশানের রঙ— ত্রিকোণ লাল বর্ণের পতাকার তিনিদিকে সাদা প্রান্তরেখা। লাল অর্থাৎ
বিপ্লব বা অগ্রগতির জন্যলাগাতার সংগ্রাম এবং সাদা অর্থাৎ শান্তির প্রতীক।
প্রকৃতপক্ষে সকলের সঙ্গে সম-অধিকারে সহাবস্থানের নীতিতে শান্তির জন্য বিপ্লব।
সমাজের অস্পৃশ্যতা, অসাম্য, কুসংস্কার, অমানবিকতা ও মানবীয় ভেদাভেদ দূর করে সাম্য
প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লব। মতুয়াদের ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রগুলি হল— জয়ডঙ্কা বা ডঙ্কা,
কাঁসর ও শিঙা। বিপ্লব এবং যুদ্ধজয়ের প্রতীক যেমন মতুয়ার হাতের নিশান— যা আসলে
বিজয়পতাকাও বটে, তেমন সেই যুদ্ধজয়ের ঘোষণা তথা উন্মাদনাকে আরও আরও মানুষের কাছে
পৌঁছে দিয়ে উদ্বুদ্ধ করতে ধ্বনিত হয় জয়ডঙ্কা, কাঁসর ও শিঙার ধ্বনি।
হরিচাঁদ ঠাকুরের দু’জন পুত্রসন্তান ও
তিনজন কন্যাসন্তান ছিলেন। তাঁর পুত্রসন্তানদের নাম যথাক্রমে— ১)গুরুচাঁদ ঠাকুর
ও ২)উমাচরণ ঠাকুর।
নারীর মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায়
হরিচাঁদ ঠাকুর এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি প্রথম থেকেই নারী ও পুরুষের
সমানাধিকারের কথা বলেছেন। তিনি বলতেন, নারীকে অবজ্ঞা করে আদর্শ গার্হস্থ্যধর্ম
প্রতিষ্ঠা করা যায় না। নারীই হলো গৃহীর আসল ভিত্তিভূমি। নারী ছাড়া সংসার হয় না।
নারীকে সঙ্গে নিয়েই ধর্মপথে অগ্রসর হতে হয়। তবে “এক নারী ব্রহ্মচারী”।
এজন্য তিনি নারীশিক্ষা, নারীর মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় সকলকে জোর দিতে নির্দেশ
দিয়েছেন।
অনেকে বলেন, হরিচাঁদ ঠাকুর
বৈষ্ণবধর্মকে সংস্কার করে মতুয়াধর্ম প্রবর্তন করেছেন। এ কথার কোনো সত্যতা নেই।
বৈষ্ণবেরা আগে যেখানে ছিল, আজও সেখানেই আছে। হরিচাঁদ ঠাকুর বৈষ্ণবদের ঘোর বিরোধী
ছিলেন। বাল্যকাল থেকেই ছিল তাঁর বৈষ্ণবদের প্রতি ঘৃণা। এমনকি পিতার আদেশ সত্ত্বেও
বৈষ্ণবদের পায়ের ধুলা মাথায় নিতে তিনি রাজি হননি। বৈষ্ণবধর্ম হিন্দু তথা
ব্রাহ্মণ্যধর্মের অন্তর্গত একটি শাখা মাত্র। হরিচাঁদ ঠাকুর জানতেন
ব্রাহ্মণ্যধর্মের কোনোকিছুকেই সংস্কার করা সম্ভব নয়। কেননা, স্বার্থান্বেষী
ব্রাহ্মণ্যধর্মীরা কোনোকালেই তাদের ধর্মের সংস্কার মেনে নেবে না। তাই তিনি
ধর্মহীনদের জন্য এক নতুন ধর্মের প্রবর্তন করেছেন। বৈষ্ণবদের কটাক্ষ করেও তিনি
বলেছেন—
“পাপের
বেসাতি সবঝোলার ভিতর।
ঝোলা
ফেলে খোলা হয়ে নাম কর সার॥”
আবার
“কোথায়
ব্রাহ্মণ দেখ কোথায় বৈষ্ণব।
স্বার্থবশে
অর্থলোভী যত ভণ্ড সব॥
তন্ত্রমন্ত্র
ভেক ঝোলা সব ধাঁধাবাজী।
পবিত্র
হৃদয় রেখে হও কাজের কাজী॥”
মতুয়াধর্ম সম্পর্কে কবি তারকচন্দ্র
সরকার মন্তব্য করেছেন—
“মালা
টেপা ফোঁটা কাটা জল ফেলা নাই।
হাতে
কাম, মুখে নাম মন খোলা চাই॥”
অনেকে বলেন যে,হরিচাঁদ ঠাকুরের পূর্বসূরি ছিলেন শ্রীচৈতন্য,
তিনিই নাকি নতুন অবতার হয়ে হরিচাঁদরূপে জন্ম নিয়েছেন। এ সমস্ত নিতান্ত অলীক
কল্পনাপ্রসূত হাস্যকর কথা মাত্র। মতুয়াধর্মে যেমন অবতারবাদের কোনো স্থান নেই, তেমন
এ কথারও কোনো সত্যতা নেই। হরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রীচৈতন্যের ধর্মান্দোলনের মধ্যে
প্রভূত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়, দু’জনের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক ও চরিত্রগত বিষয়ে
কোনো মিলই নেই।
কেউ কেউ বলেন, চৈতন্য উচ্চ-নীচ বিভেদ না করে সকলের জন্য
মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি মানবিক মর্যাদা
প্রতিষ্ঠার মূল শত্রু বৈদিক আচার, যাগযজ্ঞ, পুরোহিততন্ত্রকে বাদ দিতে পারেননি। আর
পারেননি বলেই যবন হরিদাসকে মন্দিরের ভেতর তুলে আনতে পারেননি। এমনকি নিজেও ব্রাহ্মণ
ভিন্ন অন্য কারও হাতের অন্ন গ্রহণ করেননি। তা ছাড়া তিনি কর্মবিমুখ বৈষ্ণব সমাজ
প্রণয়নে উৎসাহ দিয়েছিলেন। হরিচাঁদ ঠাকুর ও চৈতন্যের মধ্যে মূল পার্থক্যগুলি এখানে
তুলে ধরা হলো—
১)হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্ম হয়েছিল নমঃজাতির ঘরে, চৈতন্যের জন্ম
ব্রাহ্মণবংশে। ব্রাহ্মণের উপবীতও তিনি পরিত্যাগ করেননি।
২)হরিচাঁদ ঠাকুর গৃহী, আদর্শ গার্হস্থ্য প্রথা ও সংসার
জীবনের আনন্দ উপভোগসহ ত্যাগের মাধ্যমে সকলের মঙ্গলের উদ্দেশ্যে ধর্মপালন তাঁর পথ।
চৈতন্য গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী, বৈরাগ্য তাঁর সাধনার পথ।
৩)হরিচাঁদ ঠাকুর তীর্থভ্রমণের বিরোধী, চৈতন্য তীর্থে তীর্থে
ভ্রমণ করেছেন।
৪)হরিচাঁদ ঠাকুর দীক্ষামন্ত্র ও গুরুবাদের বিরোধী, কিন্তু
চৈতন্য দীক্ষামন্ত্র ও গুরুবাদে বিশ্বাসী ছিলেন।
৫)হরিচাঁদ ঠাকুর ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র, শাস্ত্র ও শাস্ত্রচারের
বিরুদ্ধে মুখর হয়েছিলেন, কিন্তু চৈতন্য সব সময় এর পক্ষে ছিলেন।
৬)হরিচাঁদ ঠাকুর নিজের স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গার্হস্থ্য ধর্ম
পালন করতে বলেছেন। চৈতন্য নিজের স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে পরকীয়া সাধন করেছিলেন।
হরিচাঁদ ঠাকুর মাত্র ছেষট্টিবছর জীবিত ছিলেন। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের
১৩ই মার্চ (১২৮৪ বঙ্গাব্দ) ভোরবেলায় তিনি প্রয়াত হন। তাঁর জন্মদিনের মতো সেদিনও
ছিল বুধবার। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র আর এক মহামানব গুরুচাঁদ ঠাকুরের
উপর তাঁর সমস্ত অসম্পূর্ণ কাজ পূর্ণ করার ভার দিয়ে যান। গুরুচাঁদ ঠাকুর পূর্ণ
নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর পিতার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।
আমরা আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ করে থাকি যে, হরিচাঁদ ঠাকুরের
মতো এমন একজন সমাজ সংস্কারক মহামানবের নাম বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসের পাতায় কোনো
স্থান নেই। শুধু যে এই একজনের নাম নেই তা নয়, ইতিহাসের পাতায় অনুন্নত সম্প্রদায়ের
কোনো মহামানবের নামই দেখা যায় না। এর কারণ কী? তাহলে কি এঁদের মধ্যে কোনো মহামানব
জন্মগ্রহণ করেননি? একটু গভীরভাবে অনুধাবন করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
বিদেশী আর্য-ব্রাহ্মণেরা এদেশে এসে বৈদিকধর্ম প্রতিষ্ঠা করে
যাগযজ্ঞ, মন্ত্রতন্ত্র, পূজাপার্বণ, শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া, পরলোক, স্বর্গ-নরক
ইত্যাদির ভয় দেখিয়ে মূলনিবাসী ভারতীয়দেরকে চিরস্থায়ী শোষণের ব্যবস্থা করে বিপথে
চালিত করেছিল। মূলনিবাসী মানুষদের শূদ্র নাম দিয়ে, কাউকে অস্পৃশ্য করে শিক্ষা,
সম্পত্তি ও অন্যান্য সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিল হাজার হাজার বছর ধরে।
হরিচাঁদ ঠাকুর দেশের সমাজপতিদের বিরুদ্ধে ধর্মান্দোলন করেছিলেন। ভেদাভেদ
সৃষ্টিকারী বৈদিকধর্মের বিরুদ্ধে এক সাম্যবাদী ধর্মের প্রবর্তনও করেছিলেন। তিনি
এবং তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর তাঁদের কর্মের দ্বারা এই মূলনিবাসী পতিত, অস্পৃশ্য
মানুষদের উদ্বুদ্ধ করেন বিদ্যাশিক্ষা করে জ্ঞান অর্জন করতে এবং এ জন্য ব্যাপক
প্রচার-প্রসারের ব্যবস্থাও গড়ে তোলেন। মূলত ওইসব মানুষদের উন্নতির কাজেই তাঁরা
সচেষ্ট ছিলেন। এটা ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদীদের স্বার্থের পরিপন্থী। এখনও ভারতবর্ষের মূল
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ্যবাদে অনুপ্রাণিত শাসকগণ। ইতিহাস রচয়িতারাও সেই
ব্রাহ্মণ্যবাদী জনগোষ্ঠীর লোক। এরা জানে হরি-গুরুচাঁদ ভাবাদর্শে শিক্ষিত হবার
অর্থ, আসল সত্য বোধগম্য হওয়া এবং তাদের স্বার্থহানীর পথ প্রশস্ত হওয়া। তাই কখনও
কোনো প্রকারে বর্ণহিন্দুরা হরিচাঁদ ঠাকুর ও তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরের নাম এবং
তাঁদের কর্মকাণ্ড ইতিহাসের পাতায় স্থান দেয়নি। ঠিক একই কারণে অনুন্নত সম্প্রদায়ের
অন্যান্য মহামানবদের নামও ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়নি।
॥ পঞ্চম পরিচ্ছেদ ॥
হরিচাঁদ ঠাকুরের জীবনী অবলম্বনে সর্বপ্রথম যে গ্রন্থখানি
লেখা হয় তার নাম “শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত”। ওই গ্রন্থ লিখেছিলেন প্রখ্যাত কবিয়াল কবিরসরাজ ‘তারকচন্দ্র সরকার’। হরিচাঁদ
ঠাকুরের একনিষ্ঠ ভক্ত মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস ও দশরথ বিশ্বাসের একান্ত অনুরোধ ও
প্রেরণায় তিনি ওই গ্রন্থ লিখতে সম্মত হয়েছিলেন। তারকচন্দ্র প্রথমে ঠাকুরের
জীবনীগ্রন্থের নাম রেখেছিলেন ‘শ্রীহরিচরিত্রসুধা’। ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’ নামকরণটি করেছিলেন গুরুচাঁদপুত্র শশিভূষণ ঠাকুর।
কিন্তু প্রথমে মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস ও দশরথ বিশ্বাস গ্রন্থের
কিয়দংশ লিখে হরিচাঁদ ঠাকুরের কাছে নিয়ে গিয়ে তাঁকে পাঠ করে শোনালে তিনি ক্রুদ্ধ হন
এবং পাণ্ডুলিপি ছুঁড়ে ফেলে দেন। শুধু তাই-ই নয়, মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস এবং দশরথ
বিশ্বাসকে তিনি এ-ও বলেছিলেন যে, ওই গ্রন্থ প্রকাশ করলে তাঁদের কুষ্ঠরোগ হবে। তার
কারণ, হয়তো বৈদিক ভাবধারায় পুষ্ট ওই লেখা ঠাকুরের মনঃপুত হয়নি। তা ছাড়া জীবিতকালে
কোনো ব্যক্তির জীবনীগ্রন্থ লেখাও উচিত নয় বলে তিনি পাণ্ডুলিপি ছুঁড়ে ফেলে
দিয়েছিলেন। অবশ্য হরিচাঁদ ঠাকুরের মৃত্যুর পঁচিশ বছর পরে মৃত্যুঞ্জয় ও দশরথের
অনুরোধে তারকচন্দ্র সরকার ওই গ্রন্থ নতুন করে লেখেন। কিন্তু তারকচন্দ্র জীবিত
থাকতে ওই গ্রন্থ ছাপানো সম্ভব হয়নি।
কবি তারকচন্দ্র সরকারের মৃত্যুর দু’বছর পরে
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত গ্রন্থ প্রথম ছাপা হয়। যতদূর জানা যায়, কোনো প্রেসই প্রথমে
গ্রন্থখানি ছাপতে রাজি হয়নি। তখনকার প্রকাশক এবং ছাপাখানার মালিকরা সকলেই ছিল
বৈদিকধর্মী বর্ণহিন্দু শ্রেণির মানুষ। কিন্তু শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত গ্রন্থখানিতে ছিল
অবৈদিক মতুয়াধর্মের কথা। বেদ-বিরোধী কথা তো ছিলই, সেইসঙ্গে ছিল দলিত, নিপীড়িত ও
অস্পৃশ্য জনগণের প্রতি বর্ণহিন্দুদের অত্যাচার-নিপীড়নের ইতিহাস এবং তাঁদের অধিকার
আদায়ের সংগ্রামের কাহিনিও। তখনকার নিয়মানুসারে ভাষাসপ্তসতী সমিতি-র অনুমতি
ছাড়া এই ধরণের গ্রন্থ কোনো প্রেসই ছাপত না। সেই অনুমতি লাভের জন্যই উক্ত কমিটির
নির্দেশমতো তারকচন্দ্র সরকারের লেখা পাণ্ডুলিপিতে অনেক পরিবর্তন, পরিবর্জন ও বহু
কিছু ব্রাহ্মণ্যধর্মী বিষয় সংযোজন করতে হয়েছে এবং তা করেছিলেন আর একজন কবি হরিবর
সরকার। এত সব করার পরেও প্রেস-ম্যানেজারকে কুড়ি টাকা ঘুষ দিয়ে নাকি গ্রন্থখানি
ছাপানো হয়েছিল।(তৎকালীন কুড়ি টাকা বর্তমানে কয়েক হাজার টাকার
সমান।)প্রেস-কর্তৃপক্ষ সে পাণ্ডুলিপিও ফেরত দেয়নি। কাজেই তারকচন্দ্র সরকার মূল
পাণ্ডুলিপিতে কী লিখেছিলেন, তা-ও সঠিকভাবে জানার উপায় নেই। তারকচন্দ্র সরকারের
পাণ্ডুলিপিতে এই যে পরিবর্তন, পরিবর্জন, সংযোজন ইত্যাদি করা হয়েছে, সেই কারণেই কি
গ্রন্থমধ্যে বৈদিক-অবৈদিকের বৈপরীত্যের এত জটপাকানো অবস্থা দেখতে পাই?
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত গ্রন্থখানি প্রকাশের জন্য অর্থ দিয়ে
সাহায্য করেছিলেন গোপাল হাওলাদার। তিনি গোপালসাধু নামে পরিচিত ছিলেন। তখন ওই
গ্রন্থের মূল্য ছিল দু’টাকা। গ্রন্থখানি ছাপানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন গুরুচাঁদ ঠাকুর
এবং ছাপানোর অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন পুত্র শশিভূষণের কাছ থেকে। গ্রন্থখানি প্রথম
প্রকাশিত হয় ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে। কলকাতার ছিদাম মুদি লেনের ‘শাস্ত্র-প্রচার প্রেস’
ছাপাখানায় নকুলচন্দ্র দে কর্তৃক মুদ্রিত হয়। তখন পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ২৫০।
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত গ্রন্থের রচয়িতা তারকচন্দ্র সরকার
বর্তমান বাংলাদেশের যশোর জেলার জয়পুর গ্রামে ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর পিতার নাম কাশীনাথ সরকার এবং মায়ের নাম অন্নদা।বাল্যকালে তারকচন্দ্র ছাঁতরা
গ্রামের পাঠশালায় পড়াশুনা করতেন। পিতার সঙ্গে বাল্যকাল থেকেই তিনি কবিগানের দলে
ছিলেন এবং বৈদিকধর্মের বহু শাস্ত্রগ্রন্থ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত ইত্যাদি,
বিশেষ করে ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ অধ্যয়নে নিবিষ্ট ছিলেন। অল্পবয়সেই তাঁর পিতৃবিয়োগ হলে
নিজেই কবিগান গাইতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি প্রখ্যাত কবিয়াল হিসাবে তৎকালীন
অবিভক্ত বঙ্গদেশে প্রভূত সুনাম অর্জন করেন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা যান।
হরিচাঁদ ঠাকুরকে নিয়ে তিনি দু’টি গ্রন্থ রচনা করেছেন — ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’ এবং ‘শ্রীশ্রীমহাসংকীর্ত্তন’।
‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’ গ্রন্থের রচয়িতা তারকচন্দ্র সরকার
যদিও তাঁর গ্রন্থে হরিচাঁদ ঠাকুরের অবৈদিক মতুয়াধর্মের কথা সবিস্তারে বর্ণনা
করেছেন, তথাপি তিনি পুরোপুরিভাবে বৈদিকধর্ম থেকে মতুয়াধর্মের স্বতন্ত্রতা বজায়
রাখতে পারেননি। একাধারে হরিচাঁদ ঠাকুরের কর্ম, বাণী ও উপদেশাবলির মধ্যে সম্পূর্ণত
বৈদিকধর্মের বিরোধিতাকে জেরালো ভাষায় প্রকাশ করেছেন, আবার অন্যদিকে তিনি
মতুয়াধর্মকে বৈদিক তথা ব্রাহ্মণ্যধর্মের অঙ্গীভূত একটি নতুন মতবাদ হিসাবে দাঁড়
করিয়েছেন মাত্র। আর ‘মহাসংকীর্ত্তন’ তো পুরোপুরি বৈদিকতায় ভরিয়ে রেখেছেন। তিনি
মূলত বৈদিকধর্মের আবর্তে মতুয়াধর্মকে গুলিয়ে একটি অদ্ভুতরূপে উপস্থাপিত করেছেন।
পরস্পর বিরোধী বক্তব্য এবং অবাস্তব কল্পনার জালে বৈদিকধর্মের পুরাণ গ্রন্থের
অনুকরণে হরিচাঁদের লীলা বর্ণনা করেছেন। ফলে মতুয়াধর্মের স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হয়েছে
এবং মতুয়াদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। অথচ হরিচাঁদঠাকুরের কার্যকলাপ এবং
উপদেশাবলি, যা স্বয়ং তারকচন্দ্র সরকার ওই গ্রন্থে বিবৃত করেছেন, তাই যদি আমরা
নিবিড়ভাবে অনুধাবন করি তাহলে মতুয়াধর্ম যে একটি স্বতন্ত্র মানবতাবাদী ধর্ম তা
বুঝতে কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়। কেননা, বেদকে অস্বীকার করে যে মতবাদ, তা কখনও
বেদাশ্রিত ধর্ম হতে পারে না।
আসলে তারকচন্দ্র ছিলেন সেই সময়ের একজন নামকরা কবিয়াল। তাঁর
পিতাও কবিয়াল ছিলেন এ কথা আগেই বলা হয়েছে। শিশু বয়স থেকেই তিনি কবিয়াল পিতার
সান্নিধ্যে কবিগান গাওয়ার পরিবেশে মানুষ হয়েছেন। কবিয়াল মানেই— তাঁরা বৈদিকধর্মের
গ্রন্থসমূহ যথা— পুরাণ, স্মৃতি, রামায়ণ, মহাভারত এবং বৈষ্ণবদের নানা গ্রন্থ
ইত্যাদি পাঠ করে জ্ঞান আহরণ করে সেই ভাবধারায় কবিগান করতেন। এমনকি বর্তমান সময়ের
কবিয়ালেরাও তার বাইরে নন। মানসিকভাবে তাঁরা কেউই বৈদিকধর্মের অলীক ধারণাসমূহকে
অন্তর থেকে বাদ দিতে পারেন না। তাঁদের রক্তমজ্জায় বৈদিকধর্মের সাথে বৈষ্ণবতন্ত্রের
রস এমনভাবে মিশে যায় যে, তাঁরা আর ওই আবর্তের বাইরে বেরোতে পারেন না। হরিচাঁদ
ঠাকুরের সান্নিধ্যে এসে তাঁর অবৈদিক তত্ত্বে মুগ্ধ হয়েও অভ্যাসের বশে বৈদিকতার
বাইরে তারকচন্দ্র বেরিয়ে আসতে পারেননি। তাই অবৈদিক মতুয়াধর্মের কথা বর্ণনা করেও
তিনি বৈদিকধর্মের সাথে তাকে এমনভাবে মিশিয়ে ফেলেছেন।
‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’ গ্রন্থে অনেক জায়গায়ই অলৌকিক কাহিনির
উল্লেখ আছে। সেগুলি হয়তো তখনকার সাধারণ মানুষের গ্রহণযোগ্যতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে
গ্রন্থকার সন্নিবেশিত করে থাকবেন। কারণ, তখনকার (ঊনবিংশ-বিংশ শতক) সাহিত্য ছিল
প্রধানত ভাববাদী এবং বৈদিক দেবদেবী কেন্দ্রীক। তখনকার দিনের শিক্ষাহীন,
কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অন্ধবিশ্বাসী সাধারণ মানুষের মধ্যে এইসব অলৌকিক কাহিনির আশ্রয়
নেওয়া ছাড়া হরিচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ ও ধর্মদর্শন প্রচার-প্রসার ঘটানো হয়তো সম্ভব হবে
না ভেবে তারকচন্দ্র সরকার ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’ গ্রন্থে অলৌকিক ঘটনার প্রবেশ ঘটিয়ে
থাকতে পারেন। কোনো সত্য ঘটনার সামান্য বিকৃতি ঘটিয়ে কিংবা শোনা কথার উপর ভিত্তি
করে অলৌকিকতার রূপ দেওয়া হতে পারে, কিংবা গ্রন্থকার বৈদিকধর্মের প্রভাবে নিজেই
ওইসব অলৌকিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তিনি সত্যাসত্য বা বৈজ্ঞানিক কারণ অনুসন্ধান
না করে অলৌকিকতাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে গ্রন্থকার যেভাবেই অলৌকিকতাকে স্থান
দিয়ে থাকুন না কেন, বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিনির্ভর মানুষদের উচিত ওইসব
অলৌকিক কাহিনিকে মুখ্য বিষয় না ভেবে মতুয়াধর্মের আসল ভাবনা, আদর্শ ও তার দর্শনকে
গ্রহণ করা। গ্রন্থকার তারকচন্দ্র সরকারও তাঁর গ্রন্থে নিবেদন রেখেছেন— সুধী
পাঠকেরা যেন রাজহংসের মতো জলটুকু বর্জন করে শুধুমাত্র দুধটুকুই পান করেন। সেই
সঙ্গে এ কথাও আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, তারকচন্দ্র সরকার অবৈদিক মতুয়াধর্মের
সঙ্গে কল্পনাশ্রয়ী বৈদিকধর্মকে যতই গুলিয়ে ফেলুন বা অলৌকিকতাকে স্থান দিন না কেন,
তিনি যদি ওই গ্রন্থ না লিখতেন তবে আমরা হরিচাঁদ ঠাকুর এবং অবৈদিক মতুয়াধর্ম-দর্শন
সম্পর্কে কিছুই জানতে পারতাম না। এ সম্পর্কে আমরা যা কিছু জানতে পারছি তা তাঁর ওই
গ্রন্থ থেকে জানতে পারছি। সুতরাং ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’ গ্রন্থের জন্যই তাঁর কাছে
আমরা চিরঋণী হয়ে থাকব; তিনি আমাদের কাছে চিরনমস্য হয়ে থাকবেন।
॥ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ ॥
জাতিধর্ম, উচ্চ-নীচ বিচার না করে
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের সম-অধিকারই হল মতুয়াধর্মের মূল কথা। হরিচাঁদ
ঠাকুর এই বিষয়টির উপর জোর দিয়েছেন সব থেকে বেশি। নারী এবং পুরুষ হিসাবে সমাজে যে
বৈষম্য বর্তমান ছিল, তিনি তার বিরোধিতা করেছেন। হিন্দুধর্মের আইনগ্রন্থ ‘মনুসংহিতা’য়
নারীকে নরকের দ্বার, সন্তান উৎপাদনের ক্ষেত্র বলে নারীর প্রতি চরম অবিচার ও অবহেলা
প্রদর্শন করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে তিনি বলেছেন— নারীকে অবজ্ঞা করে আদর্শ গার্হস্থ্য
ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা যায় না। নারী হল গৃহীর কেন্দ্রস্থল। নারী ছাড়া সংসার গড়া যায়
না। নারীকে সঙ্গে নিয়েই ধর্মপথে অগ্রসর হতে হয়। এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন— “ভেদাভেদ
জ্ঞান নাই নারী কি পুরুষ।” তখনকার দিনে বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, সেবাদাসী
প্রভৃতির মধ্য দিয়ে নারীকে যে অবমাননার বলি হতে হত তার বিরুদ্ধে তিনি বলেছেন—
“এক নারী ব্রহ্মচারী।”
হরিচাঁদ ঠাকুর নারীশিক্ষা, নারীর
মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় সকলকে জোর দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রায় দু’শো বছর আগে
নারীর অধিকার সম্পর্কে তিনি বলেছেন—
“সমাজে পুরুষ পাবে যেই অধিকার।
নারীও
পাইবে তাহা করিলে বিচার॥”
অর্থাৎ নারী ও পুরুষের সমাজে সমান
অধিকার থাকবে। স্ত্রী স্বামীর দাসী নয় বরং তার ধর্ম ও জীবনসঙ্গিনী। সংসারে উভয়ের
মর্যাদা সমান।
প্রচলিত হিন্দুধর্মে যেখানে মানুষকে
ভাববাদী, অলস, পরজীবী, শ্রমবিমুখ এবং শ্রমকে হেয় জ্ঞান করতে শিখিয়েছে, সংসারকে বলা
হয়েছে মুক্তি পথের কাঁটা, দারিদ্র্যকে বলা হয়েছে ভাগ্যচক্রের ফল, সেখানে হরিচাঁদ
ঠাকুর বলেছেন—
“অলস
লোকের তুল্য পাপী কেহ নাই।”
এ ছাড়া আরও বলেছেন—
“কাজ
করিলে কাজী, না করিলে পাজি।”
হরিচাঁদ ঠাকুর তৎকালীন সমাজের
বর্ণবৈষম্যসর্বস্ব জাতপাত ও কুসংস্কারের জন্মদাতা ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্ম ও তার
আচার-আচরণের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করে বলেছেন—
“কুকুরের
উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পেলে খাই।
বেদবিধি
শৌচাচার নাহি মানি তাই॥”
অর্থাৎ কুকুরের উচ্ছিষ্ট খেতেও তিনি
রাজি, কিন্তু বেদ এবং বৈদিক বিধান মানতে তিনি রাজি নন। তিনি বলেছেন—
“জীবে
দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা।
ইহা
ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা॥”
অর্থাৎ সমস্ত জীবের প্রতি দয়া এবং
নামের প্রতি (হরিচাঁদ ঠাকুরের আদর্শের প্রতি) রুচিবান থেকে মানুষের প্রতি বিশ্বাস
রেখে সকলের কল্যাণের জন্য নিজেকে নিষ্ঠাবান হওয়া ছাড়া আর সব আচার-অনুষ্ঠান মিথ্যা
ও নিষ্ফল। ওইসব আচার-অনুষ্ঠানে কোনো ধর্মলাভ হয় না।
হরিচাঁদ ঠাকুরের কথায়— প্রকৃত
জ্ঞানলাভের জন্য সন্ন্যাসী, বানপ্রস্থী বা ব্রহ্মচারী হওয়ার প্রয়োজন নেই। সদিচ্ছা
থাকলে গৃহে থেকে সংসারজীবন যাপনের মধ্য দিয়েই এই মহাজ্ঞান লাভ করা যায়। হরিনাম
করলে পাপক্ষয় হয় বা মুক্তিলাভ হয় এ কথা ঠিক নয়, হরিনামে প্রেমপ্রাপ্তি ঘটে ও দেহমন
শুদ্ধ হয়। সকল মানুষকে আপন বলে মনে হয়।
“ব্রহ্মত্ব
সাযুজ্য মুক্তি কৃষ্ণভক্তে দণ্ড।
হরিনামে
পাপক্ষয়কহে কোন্ ভণ্ড॥”
ঠাকুর বলেছেন—
“গৃহধর্ম
গৃহকর্ম করিবে সকল।
হাতে
কাম মুখে নাম ভক্তিই প্রবল॥”
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বৈদিকধর্ম (হিন্দুধর্ম),
বিশেষ করে চৈতন্যের বৈষ্ণবধর্মের প্রভাবে অনেকেই যখন কর্মবিমুখ ও সংসারত্যাগী হয়ে
পড়ে, তখন হরিচাঁদ ঠাকুর উপলব্ধি করলেন যে, এভাবে চলতে থাকলে সৃষ্ট সভ্যতাই বিলুপ্ত
হতে বাধ্য। তখন এই সভ্যতাকে বাঁচানোর জন্য তিনি উপরোক্ত উক্তিটি করেছিলেন। এর অর্থ
হল গৃহস্থ হিসাবে সমস্ত প্রয়োজনীয় কাজই করতে হবে। কর্মবিমুখ হয়ে ধর্মরক্ষার নামে
সংসার ত্যাগ করা চলবে না। তাহলে সৃষ্টি অচল হয়ে যাবে। তবে সেইসঙ্গে সর্বদাই নাম
করতে হবে। এখানে নাম বলতে নামধারী হরিচাঁদকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর আদর্শ,
তাঁর দর্শন স্মরণ-মনন করতে হবে এবং তা বাস্তবে রূপায়িত করার প্রচেষ্টায় নিজেকে
নিয়োজিত রাখতে হবে।
‘হরিচাঁদ ঠাকুর ও মতুয়াধর্ম’ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত রচনা
এখানেই সমাপ্ত হতে যাচ্ছে। তবে সমাপ্ত করার আগে আর একবার সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে
চাই যে, মতুয়াধর্ম এবং বৈদিক হিন্দুধর্ম এক নয়, এই কথাটি মতুয়া ভাইয়েরা
সর্বান্তকরণে মনে রাখুন। মতুয়াধর্ম ও বৈদিকধর্মের মূল পার্থক্যগুলি সংক্ষেপে আর
একবার এখানে উল্লেখ করছি।
১)বৈদিকধর্ম চতুর্বর্ণ প্রথায়
বিশ্বাসী। মতুয়াধর্মে বর্ণ বলে মানুষে মানুষে কোনো বিভাগ নেই।
২)বৈদিকধর্ম সমগ্র
সমাজের অর্ধাংশ নারীকে ধর্মশাস্ত্র পাঠ ও স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার অধিকার দেয় না।
মতুয়াধর্ম নারী-পুরুষ সকলের স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার অধিকার স্বীকার করে।
৩)বৈদিকধর্ম ছুঁৎমার্গে
বিশ্বাসী। একে অন্যকে স্পর্শ করলে কিংবা অন্য ধর্মের লোকের গৃহে আহার করলে হিন্দুর
জাত যায়। মতুয়াধর্মে ছুঁৎমার্গের কোনো স্থান নেই।
৪)বৈদিকধর্ম
বৈষম্যমূলক—সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা নেই। মতুয়াধর্ম বৈষম্যহীন—
সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার ধর্ম।
৫)বৈদিকধর্ম বিশ্বাস করে পূর্বজন্মের
পাপের ফলে নিম্নবর্ণে জন্ম হয়। মতুয়ারা এ কথা বিশ্বাস করে না। এই ধারণা
হীনম্মন্যতার সৃষ্টি করে।
৬)বৈদিকধর্মীরা বিশ্বাস করে
তীর্থভ্রমণের দ্বারা পাপ বিনষ্ট হয়। গুরুদেবের কাছ থেকে দীক্ষা না নিলে তার মুক্তি
হয় না। হরিচাঁদ ঠাকুর এ কথা অস্বীকার করে বলেছেন—
“দীক্ষা
নাই করিবে না তীর্থপর্যটন্।
মুক্তিস্পৃহা
শূন্য নাই সাধন ভজন॥”
৭)বৈদিকধর্মে অসংখ্য দেবদেবীর পূজা
আছে। মতুয়াদের পক্ষে দেবদেবীর পূজা করা নিষেধ।
৮)বৈদিকধর্মের মতো মতুয়াধর্মে
বহুবিবাহ প্রথা নেই। হরিচাঁদ ঠাকুরের বাণী— “এক নারী ব্রহ্মচারী।”
৯)বৈদিকধর্মে অনেক মন্ত্রতন্ত্র আছে। মতুয়াধর্মে কোনো মন্ত্রতন্ত্র
নেই। মতুয়াদের একমাত্র মন্ত্র হলো ‘হরিবোল’। তাঁদের সকল অনুষ্ঠান একমাত্র
হরিনামের দ্বারা সুসম্পন্ন হয়।
জয় হরিচাঁদ! জয় গুরুচাঁদ!
॥ সমাপ্ত ॥
Very good writing s. But a question is there that the great Shri Shri Harililamrita was published with the consent of great Guruchand Thakur and with his approval . In this great book there is no presence of "Matua Dharma" . In this book there is no any single word as Matua Dharma. There is " Garhastha Prasastha Dharma" or "Sukhsma Sonaton Dharma" . When it was published then Tarak Chandra Sarkar was dead.
ReplyDeleteSo why do we tell it Matua Dharma ?
Why not we tell it as Garhastha Prasastha Dharma or Sukhsma Sonaton Dharma ?
বোঝা গেল, লেখক ও একজন বুদ্ধ রোগের ভাইরাস । নম:শুদ্র জাতিই যে সব বৌদ্ধ ছিল-এই তথ্য লেখক কোথায় পেলেন?
ReplyDeleteপাল রাজাদের বিরুদ্ধে বাংলার কৈবর্ত নেতা দিব্যক; মাঝি,শ্রমিক, কৃষক ইত্যাদি সাধারন মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করে যে বৌদ্ধ ধর্ম বিরোধী ধর্ম যুদ্ধ করেছিলেন সেটা কি লেখক জানেন?
হরিচাঁদ সম্পর্কে আপনার ব্যখ্যা সম্পূর্ন আজ্ঞানতায় ভরা। নিজের নিম্ন বোধ দিয়ে বিচার টা না করলেই ভাল করতেন। জড় বুদ্ধির লোক আপনি ।