দ্বিচারিতায় মতুয়াধর্ম

দ্বিচারিতায় মতুয়াধর্ম
সুধীর রঞ্জন হালদার
          আজকাল মতুয়াধর্মের নাম তার জন্মস্হান বাংলাদেশ এবং ভারতের সমস্ত রাজ্যেই বিশেষভাবে সুপরিচিত।  স্বাধীন এই দুটি দেশে প্রচুর সংখ্যক মতুয়াধর্মী লোকের বসবাস।  বিশেষ করে দেশবিভাগের পরেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মতুয়ারা ছড়িয়ে পড়েছেন।  আবার বিশ্বের বহু রাষ্ট্রেও মতুয়াধর্মের লোক কর্মসূত্রে বসবাস করেন।  এখন মতুয়াধর্মী লোকের সংখ্যা নিতান্ত কম নয় এবং দিনে দিনে তা আরও বেড়ে চলেছে
                কিন্তু যে জিনিসটি লক্ষ করার মতো তা হলো এইসব মতুয়াধর্মী লোকেরা যদিও হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের দোহাই দিয়ে, তাঁদের নাম কীর্তন করে উৎসবাদি পালন করে থাকেন, তথাপি বেশির ভাগ মতুয়ারাই মতুয়াধর্মটিকে আলাদা কোনো ধর্ম না মেনে হিন্দুধর্মের সাথে একাত্ম করে নিয়েছেন।  এখানে হিন্দু বলতে আমি পুরোপুরি বৈদিক বর্ণধর্মের কথাই বলতে চেয়েছি।  কেউ হয়তো বলতে পারেন যে, হিন্দু তো কোনো ধর্মের নাম নয়।  কথাটি সত্যি হলেও যেটি প্রচলিত অর্থে সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে থাকেন এবং বুঝে থাকেন, আমি সেই অর্থেই বৈদিক বর্ণধর্মের নামকে হিন্দুধর্ম বলে বুঝাতে চেয়েছি
                এখন, যাঁরা তাঁদের মতে মতুয়াধর্মে নয়, মতুয়ামতে চলেন অর্থাৎ হরিচাঁদের নাম স্মরণ করেন- তাঁকে হিন্দুদের ঈশ্বর বিষ্ণুর অবতার বলে মান্য করে এবং তাঁর অলৌকিক(?) কার্যাবলী স্মরণ করেই তাঁরা তা করে থাকেন।  কারণ, পাশাপাশি তাঁরা হিন্দুদের অন্যান্য অবতার ও বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা এবং অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানও পালন করে থাকেন।  কিন্তু সত্যিই কি তাই? হরিচাঁদ ঠাকুর কি হিন্দুদের বিষ্ণুর অবতার? মতুয়াধর্ম কি আসলেই হিন্দুধর্ম? আবার কথার বেলায় অনেকেই মতুয়াধর্ম বলেন, কিন্তু ধর্মের প্রশ্নে নিজেদের আবার হিন্দুধর্মী বলে পরিচয় দেন।  একটি ধর্ম অন্য আর একটি ধর্মের অধীন হতে পারে কি? এসব প্রশ্ন সাধারণ মতুয়াদের মনে জাগে না  তাহলে এটা কি একটা দ্বিচারিতা নয়?
                মতুয়াধর্মের সর্বমান্য আদি আকরগ্রন্হ তারকচন্দ্র সরকার রচিত শ্রীশ্রীহরি লীলামৃত’’-এ মতুয়াধর্মের প্রবর্তক মহামানব হরিচাঁদ ঠাকুর সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য ও মতুয়াধর্ম সম্পর্কে নানা খুঁটিনাটি তত্ত্ব লেখা হয়েছে।  পরবর্তীকালে রচিত সমস্ত মতুয়া সাহিত্যই উক্ত গ্রন্হকে ভিত্তি করে ও অনুসরণ করে লিখিত হয়েছে এবং এখনও হয়ে চলেছে। 
                আমরা লক্ষ করেছি উক্ত গ্রন্হে পরস্পর বিরোধী বেশ কিছু তত্ত্ব ও আখ্যান হিসাবে তথ্যও দেখতে পাওয়া যায়।  এইসব পরস্পর বিরোধী বক্তব্যের ফলে মতুয়াধর্মাবলম্বী মানুষেরা অনেকটা বিভ্রান্ত।  তবে আদি  আকর গ্রন্হখানির রচনার কাল ও প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে পরস্পর বিরোধী তত্ত্ব ও তথ্যকে অনেকটা লঘু করে দেখার কারণ আছে।  সেসব বিস্তারিত তথ্য এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে দেওয়া সম্ভব নয়।  শুধু এইটুকু বলা যায় রচয়িতা তারকচন্দ্র সরকার হরিচাঁদ ঠাকুরের মুখের যে সব বাণী ও তাঁর কর্মকাণ্ডের উল্লেখ ওই গ্রন্হে করেছেন সেটাই হচ্ছে সার কথা।  বাকিসব গ্রন্হকারের সাজানো কবিকল্পিত ওই সময়ের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রচিত।  তাই কবি তারকচন্দ্র নিজেই সবিনয় বলেছেন-
                      শ্রোতাগণ হংসবৎ       দোষ ছাড়ি গুণ যত
                            দুগ্ধবৎ করুন গ্রহণ
                      হরিলীলামৃত কথা        তেমতি করি মমতা
                            কর্ণপথে পিও সর্বজন।।’’
অর্থাৎ হংস যেমন জল মিশ্রিত দুধের দুধটুকুই পান করে জলটুকু বর্জন করে, তেমনি সুধীজন তাঁর লেখার সারটুকুই গ্রহণ করে আর সব বর্জন করবেন
                তাহলে সারটুকু বলতে আমরা কোনটুকু গ্রহণ করব আর কোনটাই বা বর্জন করব, তা বুঝব কী করে? নিশ্চয়ই হরিচাঁদ ঠাকুরে বাণী ও কর্ম হিসাবে যেটুকু পাই তাকেই আমরা সার বলে মেনে নেব।  বাদবাকি সব যদি ঠাকুরের বাণী ও কর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে তা বর্জন করব।  এটাই সহজ-সরল পন্হা নয় কি?
                মতুয়াধর্ম সম্পর্কে তারকচন্দ্র বৈদিক-অবৈদিকের মিশ্রণ ঘটিয়ে যেসব কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছেন, তাকে দ্বিচারিতা বললে বোধ হয় অত্যুক্তি করা হবে না।  বৈদিক ধর্মীয় কায়দায় বহু অলীক কল্পনার কাহিনি এই গ্রন্হে স্হান পেয়েছে, যা অবৈদিক মতুয়াধর্মের সাথে সম্পূর্ণ অসঙ্গতিপূর্ণ এবং অবাস্তব বলে মনে হয়।  হরিচাঁদ ঠাকুরের মুখনিঃসৃত বাণী, যা তারকচন্দ্র সরকার তাঁর শ্রীশ্রীহরিলীলামৃতগ্রন্হে বিবৃত করেছেন তার সঙ্গে বৈদিকতার আদর্শে হরিচাঁদ ঠাকুরকে অবতারের আসনে বসাবার প্রয়াসকে সঠিক বলে মনে করা যায় না।  হরিচাঁদ ঠাকুর একজন মহামানব, তিনি বেদের বিধানকে অমান্য করে সকল মানুষকে সমমর্যাদার আসনে বসিয়েছেন, যা বৈদিকধর্মের নীতির সম্পূর্ণ বিরোধী।  বৈদিকধর্মের প্রধান শর্তই হচ্ছে বেদের বিধানকে অমোঘ বলে মান্য করতে হবে; বেদের কর্তৃত্বে কোনো প্রশ্ন করা চলবে না।  সমস্ত সমাজকে উচ্চ-নীচ স্তরভেদে চারটি বর্ণে বিভক্ত হতে হবে এবং তা মান্য করতে হবে।  কিন্তু হরিচাঁদ ঠাকুর প্রবর্তিত মতুয়াধর্মে এই মূলনীতিকেই অস্বীকার করা হয়েছে।  তিনি বৈদিকধর্মের রীতিনীতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে নতুন মতবাদ উপহার দিয়েছেন তাঁর অনুসারীদের কাছে।  সেখানে মানুষের মধ্যে উচ্চ-নীচ ভেদ করা চলবে না; ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ, আচার-অনুষ্ঠান ও অনুশাসনেও প্রভূত পার্থক্য বিরাজমান। 
                যে ধর্মে বৈদিকতার কোনো স্হান নেই সে ধর্মকে যেমন আর বৈদিকধর্ম বলা যায় না, তেমনি সেখানে বৈদিকধর্মের অবতারতত্ত্বকেও স্হান দেওয়া যায় না।  যে ধর্মে দীক্ষা নেই, তীর্থ-পর্যটনে মানা, দেবদেবীর পূজা নিষিদ্ধ সেই ধর্মকে কোন যুক্তিতে বৈদিক বর্ণধর্ম তথা হিন্দুধর্ম বলে আখ্যায়িত করা যায়?
                ঠাকুর নিজেই তাঁর অনুসারীদের মতুয়ানামে পরিচিত হতে স্বীকৃতি দিয়েছেন।  তিনি তাঁর ভক্ত-অনুসারীদের জীবনযাপন প্রণালীর যে নিয়মনীতি পালন করতে নির্দেশ দিয়েছেন, তাকে আর বেদের ধর্ম অনুসারী বলা যায় না।  তাহলে ঠাকুরের ভক্ত অনুরাগীরা কোন ধর্মের মানুষ বলে পরিচিত হবেন? ‘মতুয়াধর্ম’-এর মানুষ বলে তাঁদের পরিচয় কি যুক্তিযুক্ত নয়? যদি তাই হয় তাহলে মতুয়াধর্ম আর বৈদিকধর্ম কি এক? মতুয়াধর্মানুসারীগণ এই গ্রন্হ পাঠ করে ওইসব কাল্পনিক তথ্য, অবতারবাদ, দেবদেবীর মাহাত্ম্য ইত্যাদির উপরে গুরুত্ব আরোপ করে ভুল ঝুঝে বিভ্রান্ত হচ্ছেন এবং তার ফলেই তাঁরা বৈদিক ক্রিয়াকর্ম করে বৈদিক হিন্দুই থেকে গেছেন।  মাঝখানে হরিচাঁদের দোহাই দিয়ে মতুয়া বলে পরিচয় দিচ্ছেন।  এটাই হচ্ছে দ্বিচারিতায় মতুয়াধর্ম
                ঠাকুর বংশজাত পূজ্যপাদ প্রমথরঞ্জন ঠাকুর তাঁর বইয়ে লিখেছেন, তাঁর পূর্বপুরুষেরা নমঃজাতির লোকদের মধ্যে শিষ্য করতে এসেছিলেন।  নমঃদের কাছে ব্রাহ্মণ হল মর্ত্যে ঈশ্বরের প্রতিনিধি এবং গুরুদেব স্বয়ং ঈশ্বর।  ব্রাহ্মণেরা নমঃদের কাছে ঠাকুর বলে বিবেচিত হওয়ায় তাঁদের পদবি হয় ঠাকুর।  শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত”-এর লেখক শ্রদ্ধেয় মহানন্দ হালদারও তাই লিখেছেন।  তবে কবিরসরাজ তারকচন্দ্র সরকার প্রণীত শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’’ গ্রন্হের আদি সংস্করণে তার সত্যতা পাওয়া যায় না।  পরবর্তীকালে কোনো কোনো সংস্করণে ওই তথ্য কে বা কারা প্রক্ষিপ্ত করলেও বর্তমান সংস্করণগুলিতে আর তা দেখা যায় না।  তবে মজার বিষয় হলো, গ্রন্হমধ্যে বর্জিত হলেও প্রথম দিকে একখানি পৃষ্ঠায় শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের পূর্ব ও বর্তমান পুরুষগণের তালিকায় রামদাসের নামের পার্শ্বে বন্ধনীর মধ্যে মৈথিলী ব্রাহ্মণও তৎপুত্র চন্দ্রমোহনের নামের পার্শ্বে স্ত্রীর নাম রাজলক্ষ্মীদেবী নমঃশূদ্রের মেয়েলেখা এখনও বজায় আছে। 
                আগেই বলেছি শ্রীশ্রীহরিলীলামৃতগ্রন্হকে ভিত্তি করে পরবর্তী গ্রন্হসমূহ রচিত হয়েছে।  সেইসঙ্গে উপরোক্ত গ্রন্হ দুখানির ওই তথ্যকে ভিত্তি করেই বর্তমানে অনেক লেখক মতুয়াধর্মের উপরে বই-পুস্তক লিখতে গিয়ে হরিচাঁদ ঠাকুরকে মৈথিলী ব্রাহ্মণের বংশধর বলে উল্লেখ করে চলেছেন।  প্রশ্ন হল, যদি ওই তথ্য সত্য হবে, তাহলে শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের সান্নিধ্যে আসা অগ্রজ কবি তারকচন্দ্র সরকার তা লিখলেন না কেন? ‘ঠাকুরপদবি হওয়ারও তিনি ভিন্ন কারণ দেখিয়েছেন
                “শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিতগ্রন্হে গুরুচাঁদ ঠাকুরের কোনো কথার ভিতরেও এমন আভাষ পাওয়া যায়নি যে, তাঁর পূর্বপুরুষেরা ব্রাহ্মণ ছিলেন কিংবা তাঁরা ব্রাহ্মণের বংশধর।  অস্পৃশ্য নমঃজাতিকে নীচ ভেবে হয়তো বা ব্রাহ্মণ্যধর্মের সর্বোচ্চ বর্ণে উত্তরণের এটা একটি হীনতম মরিয়া প্রয়াস এবং এক ধরণের আত্মপ্রসাদ লাভের চেষ্টা।  আসলে হীনম্মন্যতায় ভুগে শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী ধর্ম মতুয়াধর্ম সম্পর্কে প্রচারে এ-ও এক ধরণের দ্বিচারিতা। 
                গুরুচাঁদ চরিতের গ্রন্হকার ঠাকুরদের পদবি যে বিশ্বাসছিল তা তিনি এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন।  একটি মিথ্যা মামলায় গুরুচাঁদ ঠাকুর অভিযুক্ত হলে তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে-
            প্রধান আসামী নাম শ্রীগুরুচরণ
            বিশ্বাস উপাধি বলে ঠাকুর’’ এখন।।’’ (পৃঃ ৯৪)
                শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের পূর্বপুরুষদের বর্ণনায় কবিরসরাজ তারকচন্দ্র সরকার মহোদয় শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’’ গ্রন্হের দ্বিতীয় তরঙ্গ’-তে মহাপ্রভুর পূর্বপুরুষগণের বিবরণশিরোনামে তিনি লিখেছেন-
                      এ বংশে জন্মিল যত     শুদ্ধ শান্ত কৃষ্ণ ভক্ত
                            সবে মত্ত হরি গুণ গানে
                      কৃষ্ণ ভক্তির গুণে       তার এক এক জনে
                            সাধু কি বৈষ্ণব সবে মানে।।
                                এ কয় পুরুষ মাঝে      মত্ত সাধু সেবা কাজে
                            কৃষ্ণপ্রেম ভক্তি নিরবধি
                      কেহ বা হল সন্ন্যাসী     কেহ বৃন্দাবনবাসী
                            তাতে বংশে ঠাকুর উপাধি।।’’
                মহানন্দ হালদারের রচনায় রামদাস ব্রহ্মচারী, শক্তিসাধক, ত্রিশূলধারী, অলৌকিক শক্তির অধিকারী।  তাঁর স্ত্রীও অলৌকিক শক্তির অধিকারিণী।  আবার তারকচন্দ্রের লেখায় দেখি রামদাস পরম কৃষ্ণভক্ত বৈষ্ণব ভিন্ন অন্য কিছু নন।  সুতরাং কার কথা সত্য বলে মানব? নিশ্চয়ই হরি-গুরুচাঁদের সান্নিধ্যে আসা অগ্রজ কবি তারকচন্দ্রের কথাই এ স্হলে অধিকতর সত্য বলে মেনে নিতে হবে
                 “শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’’ গ্রন্হে তারকচন্দ্র সরকার মতুয়াধর্মকে বৈষ্ণবধর্মের সঙ্গে মিলিয়ে কৃষ্ণলীলায় মত্ত হয়েছেন।  অথচ সর্বত্রই দেখি হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ বৈষ্ণবদের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণাত্মক ভূমিকাই নিয়েছেন।  গুরুচাঁদ ঠাকুরের মুখের বাণী বলে মহানন্দ হালদার নিজেই যেখানে লিখেছেন-
                      মতুয়ার পক্ষে কোন পূজা পর্ব নাই
                      শ্রীহরি মন্দিরে নিত্য পূজা করা চাই।।’’
সেখানেই আবার দেখি হিন্দুদের দেবদেবীর পূজা-অর্চনার প্রতি অনুরক্ত হয়ে তাঁর কলম আবেগ-উচ্ছাসের বাঁধ ভেঙে ছুটে চলেছে।  আসল কারণকে এড়িয়ে পূজা করবার যুক্তি হিসাবে অলীক কল্পনায় স্বপ্নের আশ্রয় নেওয়ার  যুক্তিও তিনি একাধিকবার দেখিয়েছেন।  তখনকার দিনের উচ্চশিক্ষিত পুত্রের, যিনি কলকাতায় থেকে উচ্চবর্ণীয় ছাত্রদের সঙ্গে আমোদ-ফূর্তি সহকারে লেখাপড়া করেছেন, তাঁর পূজা করবার জন্য জেদ ধরে অনশন করা ও পারিপার্শ্বিকতার চাপে পড়েই যে গুরুচাঁদ ঠাকুর দুর্গাপূজা করতে একপ্রকার বাধ্য হয়ে সম্মত হয়েছিলেন এবং সেই কারণেই সেই পূজায় তিনি নিজে অংশগ্রহণ করেননি, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হবার কথা নয়।  দুর্গাপূজা বন্ধ হলে পুনরায় চালু করবার ক্ষেত্রেও ঠিক একই যুক্তি তিনি দেখিয়েছেন।  পূজা করা প্রসঙ্গে যাঁর মুখ থেকে তিনি বলিয়েছেন-
                      প্রভু কহে, ‘এই কার্য আমি না করিব
                      মরণের ভয়ে শেষে দেবতা ডাকিব।।’’
তাঁকেই তিনি বাধ্য করেছেন স্বপ্ন নামক একটি আজগুবি ঘটনার উল্লেখ করে দুর্গাপূজা করাতে।  গুরুচাঁদ ঠাকুর দুর্গাপূজা না করলে দুনিয়ায় আর কেউ দুর্গাপূজা করবে না বলে দুর্গা স্বয়ং এসে স্বপ্নে তাঁকে বলে গিয়েছেন! এটা যে মতুয়াধর্মের মধ্যে কতখানি দ্বিচারিতা ও মতুয়াদের কতখানি বিভ্রান্ত করে চলেছে তা বলে শেষ করা যায় না।  লেখক নিশ্চয়ই জানতেন যে, এই দুর্গাপূজা একমাত্র বাঙালি ভিন্ন ভারতবর্ষের অন্য কোনো অঞ্চলে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের ভিতরেও প্রচলিত নেই।  কৃত্তিবাসী রামায়ণে রাম কর্তৃক দুর্গাপূজা করবার যে কাহিনি লেখা হয়েছে, তাও কৃত্তিবাসের কপোলকল্পিত, বাল্মীকির মূল রামায়ণে দুর্গাপূজার কোনো নামোল্লেখ পর্যন্ত নেই।  দুর্গাপূজা বাঙালি ধনী ও জমিদারদের একটি বিলাসিতার উৎসব বলে প্রচলিত হয়েছিল।  গুরুচাঁদপুত্র সেই ধনী ও জমিদারপুত্র বন্ধুদের সাথে নিজের সমতা বজায় রক্ষা করবার জন্যই যে জেদ ধরে অনশন করেছিলেন- সেটা ভাবা কি অন্যায় হবে?
                যাই হোক, হরিচাঁদ ঠাকুর অমানবিক বৈদিক তথা ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে বৌদ্ধধর্মের সাম্য, মৈত্রী ও প্রেমকে আদর্শ করে প্রাচীন সনাতন ধর্মকে অনুসরণ করে মতুয়াধর্মনামক যে নতুন ধর্মের সৃষ্টি করেছিলেন, যার ধারক ও বাহক হয়ে গুরুচাঁদ ঠাকুর আমরণ দলিত পীড়িত মানুষদের মধ্যে জাগরণের সৃষ্টি করে যে আদর্শের দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন, তা অতি যত্নের সাথে লেখক মহানন্দ হালদার বিস্তৃতভাবে শ্রীশ্রগুরুচাঁদ চরিতে’’ লিখেছেন সন্দেহ নেই; কিন্তু সেই সঙ্গে বিপরীতধর্মী বৈদিকধর্মের রীতিনীতি, আচার-আচরণ, শাস্ত্রগ্রন্হ-পুরাণাদির গালগল্প মিশিয়ে মতুয়াধর্মের স্বাতন্ত্র্যকেও বিসর্জন দিয়েছেন।  যদি আমরা বৈদিকধর্মের শাস্ত্রগ্রন্হ ও পুরাণাদির আদর্শকেই ধর্ম বলে মেনে নিয়ে অলীক দেবদেবীর পূজার্চনাই করব, তাহলে নতুন করে আমাদের শ্রীশ্রীহরি-গুরুচাঁদের প্রয়োজনীয়তা বা সার্থকতাও থাকে না, অবৈদিক মতুয়াধর্মের গুরুত্বও হারিয়ে যায়।  একেই দ্বিচারিতায় আক্রান্ত মতুয়াধর্ম’- একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।  আশা করি সমস্ত অসাম্য ও অলীক কল্পনার বৈদিক ধ্যানধারণা বর্জন করে শুধুমাত্র ঠাকুর শ্রীশ্রীহরিচাঁদের প্রবর্তিত সাম্য, মৈত্রী, সত্য, প্রেম ও পবিত্রতার ধর্ম- মতুয়াধর্মের আলোকে সকল মতুয়াদের চিন্তাচেতনা সর্বদাই বিরাজ করবে।  জয় হরিচাঁদ, জয় গুরুচাঁদ!


Comments