মতুয়াধর্ম বনাম আম্বেদকরবাদ

মতুয়াধর্ম বনাম আম্বেদকরবাদ
সুধীর রঞ্জন হালদার
দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ করেছি যাঁরা মতুয়া বলে নিজেদের দাবি করেন, তাঁদের বেশির ভাগ মানুষেরা বাবাসাহেব ডঃ বি.আর.আম্বেদকরের নাম শুনতে পছন্দ করেন না। আম্বেদকরবাদী হওয়ার তো কথাই নেই। আবার যাঁরা আম্বেদকরবাদী তাঁরা বেশির ভাগই মতুয়াদের ঘৃণা করেন। হরিচাঁদ ঠাকুর কিংবা গুরুচাঁদ ঠাকুরের নামও তাঁদের কাছে ব্রাত্য। খুব অল্পসংখ্যক মানুষই আছেন যাঁরা মতুয়াধর্ম ও আম্বেদকরবাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখেন না। মতুয়াধর্মের প্রবর্তক হরিচাঁদ ঠাকুর ও তার প্রচারক গুরুচাঁদ ঠাকুরের মতাদর্শ ও কাজকর্ম এবং আম্বেদকরের মতাদর্শ ও কাজকর্ম একই উদ্দেশ্যে পরিচালিত। সমাজের সর্বনিম্ন শ্রেণির মানুষ, যাঁদের অস্পৃশ্য বলা হত, মূলত তাঁদের এবং সমাজের অন্যান্য অবহেলিত মানুষদের উন্নতি করা এবং সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার অর্জন করার জন্যই ছিল তাঁদের আজীবন সংগ্রাম।
দুঃখের বিষয় উভয় শ্রেণির মধ্যে এই যে মতপার্থক্য এর সঠিক কারণ বিশ্লেষণ করে এই মতবিভেদ দূর করা নিম্নবর্গীয়দের স্বার্থের জন্য একান্তই যে জরুরি, এ কথাটি খুব কম লোকই উপলব্ধি করেন। শিক্ষিত মানুষেরা, বয়স্ক কিংবা নব্য যুবক, মতুয়া পরিবারের কিংবা অমতুয়া পরিবারের যাই হোন না কেন, তাঁরা মতুয়াদের ছেড়া-ময়লা পোশাক পরা, তাঁদের ভাষায়- অভব্য পোশাকে ডঙ্কা পিটিয়ে ‘হরিবোল’ ধ্বনিতে লাফানোকে অসভ্যতা মনে করেন। তাঁদের মধ্যে যাঁরা একটু আধটু আম্বেদকর সম্বন্ধে জানেন, তাঁরা আবার এই অন্ধবিশ্বাসে নাচানাচি করাকে কুসংস্কার বলে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেন। আসলে এই উভয় দলের একদল হরি-গুরুচাঁদের আণ্দোলন সম্পর্কে কিছুই জানেন না, জানার চেষ্টাও করেন না। অপর দল আম্বেদকর সম্পর্কেও সম্পূর্ণ অন্ধকারে। শুধু অন্ধকারে বলা ভুল হবে, আম্বেদকর সম্পর্কে তাঁদের গুরু-গোঁসাইদের দ্বারা ভুল পথে পরিচালিত হয়ে মতুয়াধর্মকে হিন্দুধর্মের একটি অঙ্গ বলে ভেবে বসে আছেন। হরি-গুরুচাঁদকে হিন্দুধর্মের অবতার জেনে তাঁদের প্রকৃত আন্দোলন সম্পর্কে কোনো ধারণাই তাঁদের মধ্যে নেই। আম্বেদকর তো হিন্দুদের বিরুদ্ধে গিয়ে বৌদ্ধ হয়েছিলেন। হিন্দু হয়ে তাঁরা এই ধর্মত্যাগীকে শ্রদ্ধা করবেন কোন যুক্তিতে? তা ছাড়া তাঁদের ধর্মগুরুর বংশধর স্বয়ং প্রমথরঞ্জন ঠাকুর মহাশয় আজন্ম যে আম্বেদকরের বিরোধিতা করে গেছেন, তাঁকে তাঁরা কী করে শ্রদ্ধা করতে পারেন? এমন কথাও শোনা গেছে যে, কোনো এক সময়ে প্রমথরঞ্জন ঠাকুর নাকি বলেছিলেন যে, ডঃ আম্বেদকর যদি মধুমতী নদীর ওপারে যান (পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর যাওয়া উপলক্ষ্যে) তাহলে তিনি তাঁর পা ভেঙে দেবেন! এ জন্যই মতুয়ারা আম্বেদকরকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন না।
অপরদিকে যেসব আম্বেদকরবাদী আম্বেদকর সম্পর্কে পড়াশুনো করেছেন, তাঁর আন্দোলন সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞানার্জন করেছেন, তাঁরা ওইসব লম্বা চুলদাড়িওয়ালা, মাথা ঝাঁকানো মতুয়াদের অশিক্ষিত ভেবে দূরে সরিয়ে রাখেন। হরি-গুরুচাঁদকেও ওইসব অশিক্ষিত মতুয়াদের গুরু-গোঁসাই ভেবে তাঁদের সম্পর্কে কিছু জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন না। সেই আগ্রহ যদি তাঁদের থাকত, তাহলে তাঁরা জানতে পারতেন, আম্বেদকর পশ্চিম ভারতে জন্মে সারা ভারতব্যাপী যে অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করেছেন, পূর্বভারতে তাঁর আগেই জন্মে হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুর সেই একই আন্দোলন করে গিয়েছেন। উভয় দলের মধ্যে পরস্পর সম্পর্কে এই যে না জানা, তার কারণেই এই পরিস্থিতি।
এবার এই দুই আন্দোলনের স্রষ্টাদের কর্মধারা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করলেই বুঝতে অসুবিধা থাকবেনা যে তাঁদের আন্দোলনের মধ্যে কী চমৎকার মিল।
হরিচাঁদ ঠাকুর ডঃ আম্বেদকরের জন্মের অনেক আগেই পূর্বভারতে বাংলার বুকে অস্পৃশ্য নমঃজাতির ঘরে জন্মেছিলেন। অস্পৃশ্য হওয়ার কারণে নমঃজাতির লোকেরা ধর্মে পতিত ছিলেন। অর্থাৎ তাঁদের ধর্মাচরণের কোনো অধিকার ছিল না। অথচ তাঁরা নিজেদের হিন্দু বলে ভাবতেন। হিন্দুধর্মের সমস্ত শাস্ত্রগ্রন্থেই জাতপাতের বিধান থাকায় নমঃজাতির লোকেরা হিন্দুদের কাছে অস্পৃশ্য হয়ে মানুষের সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবন নিয়ে যুগ যুগ ধরে বাস করছিলেন। হরিচাঁদ ঠাকুর প্রথমেই এই ধর্মের বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। তিনি বললেন, যে ধর্মের বিধানে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, উচ্চনীচ তৈরি করে সে ধর্মের বিধান তিনি মানেন না। তিনি বেদের বিধানকে কুকুরের উচ্ছিষ্টের সাথে তুলনা করলেন। তিনি বললেন, সকল মানুষ সমান, সবার সমান অধিকার। ব্রাহ্মণ শূদ্র বলে কিছু নেই। মানুষের পরিচয় তার কর্মে। তিনি সবাইকে সত্য-প্রেম-পবিত্রতার বন্ধনে বেঁধে সাম্যবোধে পরিচালিত হয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্বের ধর্মে দীক্ষিত হতে বলেছেন। এজন্য তিনি নতুন ধর্ম প্রবর্তন করেছেন, যার নাম “মতুয়াধর্ম”। তিনি তাঁর ধর্ম প্রচার ও সকলের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরকে নির্দেশ দিয়ে যান। গুরুচাঁদ ঠাকুর পিতার আদেশ শিরোধার্য করে আজীবন সেই আদর্শ পালন করে গেছেন। তিনি যেমন সমস্ত নিম্নবর্গীয় মানুষ তথা মতুয়াদের মধ্যে শিক্ষা-আন্দোলন করেছেন, তেমনি সেইসব মানুষদের চাকরি, ব্যবসা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার সাথে সাথে সমাজের সর্বাঙ্গীন উন্নতিকল্পে তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তখনকার ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে এইসব মানুষদের জন্য নানা অধিকারও তিনি আদায় করেছিলেন। আসলে হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ দু’জনে মিলে একই উদ্দেশ্য সাধন করেছিলেন।
অপরপক্ষে ডঃ বি.আর.আম্বেদকর জন্মেছিলেন পশ্চিম ভারতের মাহার জাতির ঘরে; নমঃজাতির মতো এই মাহার জাতিও ছিল অস্পৃশ্য। তাঁদেরও ধর্মকর্ম ও বিদ্যাশিক্ষার অধিকার ছিল না। তিনি অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে বিদ্যাশিক্ষা করতে পেরেছিলেন এবং পৃথিবী বিখ্যাত শ্রেষ্ঠ বিদ্বান হিসাবে গণ্য হয়েছিলেন। তিনি হিন্দুধর্মের শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে অমানবিক বিধানগুলিকে বর্জন করে হিন্দুধর্মকে মানবিক করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতা থেকে হিন্দুধর্মের স্বার্থান্বেষী রক্ষাকর্তাদের মন টলাতে পারেননি। অবশেষে তিনি লক্ষ লক্ষ অনুগামী নিয়ে জাতপাতের ধর্ম হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ করে বৌদ্ধধর্মে ফিরে গিয়েছিলেন। ডঃ আম্বেদকরও যুগ যুগ ধরে হিন্দুদের দ্বারা নির্যাতিত মানুষদের উন্নতির জন্য, অধিকার আদায়ের জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তার ফলেই ওইসব মানুষেরা আজ মানুষের অধিকার ফিরে পেয়েছেন। তিনি ছিলেন সমগ্র নির্যাতিত মানুষের পরম আদরের বাবাসাহেব। তিনিই ছিলেন স্বাধীন ভারতের সংবিধানের রূপকার।
আমার এই আলোচনায় আশা করি উভয় দলের লোকেরা বুঝতে পারছেন হরি-গুরুচাঁদ ও আম্বেদকরের আন্দোলনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাঁরা ভারতের দুই প্রান্তে জন্মে হিন্দুধর্মের অমানবিক নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। নির্যাতিত মানুষের মানবিক অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করেছেন। সমাজ পরিবর্তনের জন্য আজন্ম নিরলস পরিশ্রম করেছেন। মানুষকে শিক্ষিত হতে বলেছেন, সংঘবদ্ধ হতে বলেছেন, আধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে বলেছেন। সকল ক্ষমতার উৎস রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে বলেছেন। তাহলে শুধু মাত্র অজ্ঞতার কারণে একদল আর একদলকে দূরে সরিয়ে রেখে নিজেদের দুর্বল করে রাখা কেন?

তাই সকলের কাছে বিনীত অনুরোধ, যাঁরা আম্বেদকরবাদী বলে নিজেদের পরিচয় দেন, তাঁরা হরি-গুরুচাঁদ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানুন, এঁদের সম্পর্কে যুক্তি-বিজ্ঞানসম্মত লেখা পড়ুন, অন্ধবিশ্বাসী কিংবা ধর্মান্ধ মতুয়াদের লেখা নয়। তাহলেই তাঁদের কর্মকাণ্ডের সঠিক তথ্য জানতে পারবেন। আর যাঁরা মতুয়া বলে পরিচয় দেন, তাঁরা ধর্মীয় গোঁড়ামী ছেড়ে, অন্ধবিশ্বাস দূরে ছুঁড়ে ফেলে বাবাসাহেব ডঃ আম্বেদকর সম্পর্কে জানুন। তাঁর সম্পর্কে সঠিক তথ্যের বইয়ের অভাব নেই। তাহলে সমস্ত সংশয় দূর হয়ে যাবে।

Comments